নুসরাত সুলতানা , বিশেষ সংবাদদাতাঃ
শব্দসন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে চাই সামাজিক সচেতনতা
শব্দদূষণ নামের নীরব ঘাতক রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ‘শব্দসন্ত্রাসে’ রূপ নিয়েছে। ঢাকা শহরে শব্দদূষণের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। রাজধানীতে যেখানে-সেখানে যানবাহনে হর্ন বাজানোর ওপর বিধি-নিষেধ থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, পথে ট্রাফিক জ্যাম থাকলেও অযথা হর্ন বাজানো হচ্ছে। অনেক সময় চালকরা আবার ইচ্ছা করে হর্ন বাজাচ্ছেন! মোটরসাইকেলগুলোর কারণে-অকারণে হর্ন বাজানোর কারণে মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। মোটরসাইকেলসহ রাজধানীর অনেক যানবাহনে এখনো ‘হাইড্রোলিক হর্ন’ ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে ট্রাকে হাইড্রোলিক হর্ন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে হাইকোর্ট যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো হলে গাড়িসহ তা জব্দের নির্দেশনা আছে। কিন্তু কেউ এই নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করছেন না। মূলত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যেখানে-সেখানে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করা হচ্ছে। স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পাশ দিয়ে যানবাহন চলার সময় হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ হলেও তা মানা হচ্ছে না।
শব্দদূষণ নামের এই মারাত্মক সমস্যা মূলত মানুষেরই সৃষ্টি। যারা শব্দদূষণ করছেন তাদের মধ্যে বিবেক-বুদ্ধি তো কাজ করছেই না, আবার কেউ শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে অনুরোধ করলে বা প্রতিবাদ করলে হিতে বিপরীত আকার ধারণ করছে! যদিও এই পরিবেশগত সমস্যা নিয়ন্ত্রণযোগ্য। শব্দদূষণের বহুবিধ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে যানবাহনের মাত্রাতিরিক্ত শব্দ, বিভিন্ন অবকাঠামো-নির্মাণকাজের শব্দ, মিছিলে কিংবা অন্যান্য কাজে মাইকের অতিরিক্ত শব্দ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে শহরে বাসার ছাদে ব্যান্ডসংগীতের আয়োজন, কলকারখানার শব্দ ইত্যাদি। হর্ন-মাইকের বিরক্তিকর শব্দ মানুষের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে হর্ন-মাইকের ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ আমাদের দেশে যেখানে-সেখানে এই মাইকের ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটা, রাতের ঘুম নষ্ট হওয়াসহ জনজীবনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পরিবেশ অধিদফতরসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা বলছে, রাজধানীতে শব্দের মাত্রা এর ‘মানমাত্রার’ চেয়ে দেড় থেকে দুই গুণ বেশি। শব্দদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। বৈশি^ক এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের শিশুদের কানের সমস্যা বিশে^র যে কোনো দেশের শিশুদের চেয়ে বেশি। বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, বসতি এলাকায় দিনের বেলা ও রাতে শব্দমাত্রা হওয়া উচিত যথাক্রমে ৫৫ ও ৪৫ ডেসিবেল। বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ও রাতে যথাক্রমে ৬৫ ও ৫৫ ডেসিবেল। শিল্পাঞ্চলে দিনে ও রাতে যথাক্রমে ৭৫ ও ৬৫ ডেসিবেল। এছাড়া হাসপাতালের মতো নীরব এলাকায় শব্দমাত্রা হওয়া উচিত দিনে ও রাতে যথাক্রমে ৫০ ও ৪০ ডেসিবেল। শব্দের মাত্রা এর চেয়ে বেশি হলে অর্থাৎ মানুষের সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করলে তাকে ‘শব্দদূষণ’ বলে গণ্য করা হয়। সহনীয় মাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত শব্দ যদি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অনেক দিন ধরে নিরূপায় হয়ে শুনতে হয় তাহলে শরীর ও মনে তার প্রভাব তীব্রভাবে পড়ে।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে শহরের বিভিন্ন এলাকাকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, শিল্প এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকা। এসব এলাকায় দিন ও রাতভেদে শব্দের মাত্রাও নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব এলাকায় শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৪০ থেকে ৭০ ডেসিবেলের মধ্যে। অথচ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় নির্ধারিত মানদন্ডের চেয়ে গড়ে প্রায় দেড়গুণ বেশি শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোথাও শব্দের মাত্রা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে তিন গুণেরও বেশি হচ্ছে!
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ এর ক্ষমতাবলে ‘শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬’ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালা অনুসারে নীরব, আবাসিক, মিশ্র, শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য একমাস কারাদন্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদন্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। আবার ‘মোটরযান আইন- ১৯৮৮’ এর ১৩৮ ধারায় উল্লেখ আছে, যদি কোনো ব্যক্তি কিংবা মোটরগাড়ির মালিক বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি মোটরযানে এমন ধরনের হর্ন বা শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্র সংযোজন বা ব্যবহার করেন, যা সংশ্লিষ্ট এলাকায় যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষ এ আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ করেছে কিংবা কোনো নির্দিষ্ট স্থানে অনুরূপ হর্ন বা যন্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহার করেন, তবে সর্বেŸাচ ১০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হবে। কিন্তু বাস্তবে এসব আইনের তেমন প্রয়োগ দেখা যায় না। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ও প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিমালা থাকা সত্ত্বেও এর ব্যবহার নেই, এর থেকে দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে! ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আবার রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করার অভিযোগে প্রতিদিন জরিমানা ও মামলা হলেও এই উচ্চমাত্রার শব্দসৃষ্টিকারী বিশেষ হর্নের ব্যবহার কমছে না। রাজধানী ঢাকা যেন শব্দদূষণের শহর! শব্দদূষণের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস, আলসার, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, হৃদরোগ, বধিরতাসহ সর্বোপরি শরীর ও মনে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শব্দদূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। এমনকি মায়ের গর্ভে থাকা সন্তানও শব্দদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এমনকি তাদের শ্রবণশক্তিও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এছাড়া শিশুর বেড়ে ওঠা ও মেধার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শব্দদূষণে। অসুস্থ ব্যক্তিরাও শব্দদূষণে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, এভাবে শব্দদূষণ অব্যাহত থাকলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যার ৩ ভাগের ১ ভাগ মানুষ কানে কম শুনবে।
বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, ৬০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ মানুষকে অস্থায়ী বধির এবং ১০০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ মানুষকে স্থায়ীভাবে বধির করে দেয়। আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত এলাকাকে নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় মোটরগাড়ির হর্ন বাজানো বা মাইকিং করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কিন্তু এসব আইন কি মানা হচ্ছে? রাজধানী ঢাকা বা শুধু বিভাগীয় শহর নয়, জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতেও শব্দদূষণ বেড়েই চলেছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে কাজ করা বেশির ভাগ ট্রাফিক পুলিশ সদস্য বধির হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। সব দিক বিবেচনায় ঝুঁকি ও দূষণমুক্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও নিরাপদ জাতি গঠনে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। আইনের যথাযথ পদক্ষেপ ও সামাজিক সচেতনতা না থাকায় হর্ন বাজানো বা শব্দদূষণের প্রবণতা বেড়েই চলেছে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যানবাহনের চালক ও মালিকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। পথেঘাটে, যেখানে-সেখানে হর্নের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। শব্দদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর; এটা সবাইকে বোঝাতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের হাতে শব্দের মাত্রা মাপার যন্ত্র দেওয়া হলেও তার ব্যবহার সচারচর দেখা যায় না। এছাড়া রাস্তায় যানজট থাকলেও যেসব চালক অযথা হর্ন বাজায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এ ব্যাপারে শব্দের মাত্রা পরিমাপের যন্ত্র নিয়ে নিয়ে ট্রাফিক পুলিশকে আরো সক্রিয় হতে হবে। ঢাকা শহরটা এমনিতেই ছোট। অনেক সময় আবার বোঝারও উপায় থাকে না কোনটা আবাসিক, নীরব, অথবা বাণিজ্যিক এলাকা। বেশির ভাগ স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, বাসাবাড়ি রাস্তা বা অলিগলির সঙ্গে বা পাশে অবস্থিত। এ ব্যাপারে যানবাহনের চালকদের হর্ন ব্যবহারে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। ঢাকার রাস্তার প্রতিটি স্কুল-কলেজ, হাসপাতালসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে শব্দমাত্রার সতর্কতামূলক দিকনির্দেশনা ‘বাধ্যতামূলকভাবে’ থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে। এতে করে চালকরা হর্ন ব্যবহারে আরো সতর্ক হবে। পাশাপাশি নির্দেশনা অমান্য করলে চালকদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরের দায়িত্বশীলদের উদাসীনতা দূর করতে হবে। তবে সবচেয়ে জরুরি হলো সামাজিক সচেতনতা। সামাজিকভাবে সব ধরনের চালক ও সাধারণ জনগণ যত সচেতন হবে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা তত সহজ হবে।
ঢাকার রাস্তায় আগামী ২৭ আগস্টের পর কোনো যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো হলে গাড়িসহ তা জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত বুধবার এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর বেঞ্চ এই আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়, ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ করতে হবে। আমদানি বন্ধের পাশাপাশি বাজারে থাকা সব হাইড্রোলিক হর্ন আগামী সাত দিনের মধ্যে জব্দ করতে হবে। কোর্টের এই নির্দেশনা অত্যন্ত সময়োপযোগী। এটি যেন বাস্তবায়ন হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারে সরকারি নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করছে না কেউ। বরং দেশের অধিকাংশ যানবাহনেই হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করা হচ্ছে। সাধারণভাবে মানুষ ৪০-৪৫ ডেসিবল মাত্রার শব্দই ভালো শুনতে পায়। তারচেয়ে বেশি মাত্রার শব্দ মানুষের শ্রবণশক্তিসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে। অথচ দেশের ৮০ শতাংশ যানবাহনে এখনো ব্যবহার হচ্ছে হাইড্রোলিক হর্ন। যা ১০০ ডেসিবলেরও বেশি মাত্রার শব্দ সৃষ্টি করে থাকে। বিআরটিএ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মোটর ভেহিকল অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী দেশে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। শুধু তা-ই নয়, যানবাহনে এ হর্ন ব্যবহার করলে জরিমানারও বিধান রয়েছে। কিন্তু কেনাবেচায় কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা না থাকায় বাজারে প্রতিনিয়ত বিক্রি হচ্ছে মারাত্মক শব্দদূষণের উৎস এসব হর্ন। সহজলভ্য হওয়ায় যানবাহনেও চলছে এসবের ব্যবহার। মূলত বিআরটিএর আইন এবং এনবিআরের আমদানি নীতির মধ্যে সমন্বয় না থাকার কারণে ক্ষতিকর এ হর্নের ব্যবহার বন্ধ করা যাচ্ছে না। এজন্য সরকারি দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় এনে হাইড্রোলিক হর্নের আমদানি, উৎপাদন ও বাজারজাত বন্ধ করা জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
সূত্র জানায়, বাজারে চাহিদা থাকায় হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও অবাধে আমদানি হচ্ছে। কারণ হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও আমদানি কোনো সমস্যা নেই। কারণ সরকারের আমদানি নীতিতে হাইড্রোলিক হর্নের বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। হাইড্রোলিক হর্ন ও ইলেকট্রিক হর্নের জন্য আলাদা এইচএস কোডও নেই। এনবিআরের প্রথম শিডিউল অনুযায়ী হর্নের এইচএস কোড ৮৫১২.৩০.০০। এ কোডে সব ধরনের সাংকেতিক শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্রাংশ আমদানি করা যায়। ফলে প্রতি বছর কতো সংখ্যক হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি হচ্ছে দেশে তা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই নির্দিষ্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে সারাদেশে ১ লাখ ১৪ হাজার ট্রাক, ৩৫ হাজার ৯৬৪টি বাস, ১৬ হাজার ৯২৭টি কাভার্ড ভ্যান, ২২ হাজার ৬৩০টি ডেলিভারি ভ্যান, ৫ হাজার ৯৮৭টি কার্গো ভ্যান, ২৬ হাজার ৮৯৬টি মিনিবাস ও ৪ হাজার ১৩০টি ট্যাংকার চলাচল করে। এসব পরিবহনের ৮০ শতাংশই হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করে বলে ট্রাফিক পুলিশ সূত্রে জানা যায়। প্রতিটি যানই বছরে একাধিক হর্ন ব্যবহার করে থাকে। আর ওসব হর্নের প্রতিটির দাম ৪শ’ থেকে ১ হাজার ৫শ’ টাকা পর্যন্ত। সে হিসাবে দেশে পণ্যটির কমপক্ষে ১০ কোটি টাকার বাজার রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, রাজধানীর অধিকাংশ যানবাহনেই উচ্চমাত্রার, কর্কশ শব্দ সৃষ্টিকারী হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার হচ্ছে। আর ঢাকার বিভিন্ন স্থানের গাড়ির যন্ত্রাংশের দোকানে ওসব হাইড্রোলিক হর্ন প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে। তাছাড়া জেলা শহর ও মহাসড়কগুলোতে চলাচলকারী যানবাহনেও ওই হর্ন প্রতিনিয়ত ব্যবহার হচ্ছে। অথচ ১৯৮৩ সালের মোটর ভেহিকল অর্ডিন্যান্সে নিষিদ্ধ হর্ন ব্যবহার করলে জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয়। আর ১৯৪০ সালের দ্য মোটর ভেহিকল বিধিমালায়ও হাইড্রোলিক হর্নকে নিষিদ্ধ করা হয়। অর্ডিন্যান্সের ১৩৯ ধারায় নিষিদ্ধ হর্ন ব্যবহারে ১০০ টাকা জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আর মোটরযান বিধিমালার ১১৪ ধারায় হর্ন ব্যবহার-বিষয়ক ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, প্রতিটি যানে অবশ্যই বাল্ব (ইলেকট্রিক) হর্ন ব্যবহার করতে হবে। ওই ধারার মাধ্যমে উচ্চ ও বিকট শব্দ সৃষ্টিকারী এয়ার প্রেসার হর্ন (হাইড্রোলিক) সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাছাড়া একাধিক শব্দের একটি সাকসেশন তৈরি করে এমন বহুস্বরের হর্ন ব্যবহার করা যাবে না বলেও তাতে উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে- এমন হর্ন ব্যবহার করা যাবে না যার শব্দ কর্কশ, উগ্র ও উচ্চ। তবে অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশের গাড়ি ও কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমোদনপ্রাপ্ত পরিবহন এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে না। পাশাপাশি হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারের বিরুদ্ধে জরিমানার বিধান থাকলেও যথাযথভাবে তা প্রয়োগ হচ্ছে না। বরং জরিমানা মাত্র ১০০ টাকা হওয়ায় গাড়ির চালকরাও বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে না। তাছাড়া অনেক চালক আইনে হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধের বিষয়টি জানেও না।
এদিকে যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বিষয়ে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) বিজয় ভূষণ পাল বলেন, প্রতিদিন ভ্রাম্যমাণ আদালতের ৪/৫টি দল মাঠে কাজ করেন। তারা ফিটনেস, কালো ধোঁয়া, অবৈধ পার্কিং, শব্দদূষণ ও অধিক মাল ও যাত্রী পরিবহনসহ বিভিন্ন অপরাধের আইনানুগ ব্যবস্থা নেন। তবে এখন মোটরযান আইনটি সংশোধনের কাজ চলছে। খসড়া প্রস্তুত হয়েছে। নতুন আইনে হাড্রোলিক হর্ন ব্যবহার নিষিদ্ধের বিষয়টি আরো গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করা হবে।
অন্যদিকে এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান বলেন, জনকল্যাণে কাজ করাই এনবিআরের কাজ। যদি আইনগতভাবে কোনো ক্ষতিকর জিনিসপত্র আমদানির সুযোগ থেকে থাকে তাহলে তা বন্ধ করার বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হবে।
Add Comment