মাদারীপুরের নূর পখিরার হযরত পীর আলহাজ্ব হযরত মাওলানা শাহসূফী নূর মোহাম্মদ (রহঃ) ১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ মোতাবেক ৩০শে ভাদ্র ১৪০৩ সন আরবী ১লা জমদিউল আউয়াল ১৪১৭ এর দুপুর ২.৩০ মিনিটে মহান আল্লাহ পাকের দিদার লাভের আশায় চিরদিনের জন্য লক্ষ লক্ষ জেসমানী ও রূহানী আওলাদ, ভক্ত, মুরীদ, মুহেব্বীন, আশেকীন, খোলাফা ও পরিবার-পরিজন রেখে তাঁর রূহ বা আত্মা রক্ত মাংসের শরীর হতে জান্নাতুল ফিরদাউসের পথে রওনা হয়েছিল। আজ পখিরার হযরত পীর সাহেব (রহঃ) আমাদের চর্মচক্ষুর অন্তরালে থাকলেও আমাদের উপস্থিতি এবং কর্মকান্ড জ্ঞাত। কারণ আল্লাহর ওলীগণ মৃত্যুবরণ করেন না। আল্লাহর ওলীগণ দুনিয়ায় অবস্থানকালীন সময়ের চেয়ে ইন্তিকালের পর রূহানী শক্তি শত সহস্র গুণে বেড়ে যায়। জাগতিক সীমা রেখার উর্ধ্বে উঠে তাদের ফয়েজ ও তাওয়াজ্জুহ আম হয়ে যায়, যা যে কেউ ইচ্ছে করলে গ্রহণে সক্ষম হয়।
মাদারীপুরের নূর পখিরার হযরত পীর সাহেব কেবলা (রহঃ) ছিলেন-ছারছীনা দরবার শরীফের দাদা হুজুর মুজাদ্দিদে জামান জনাব হযরত মাওলানা নেছার উদ্দিন আহম্মদ (রহঃ) এর হাতে গড়া একজন পূর্ণাঙ্গ খলিফা এবং পখিরার মরহুম দাদা হুজুর কাইউয়ুমে জামান, গাউসে পাক, শাহসূফি, হযরত মাওলানা ক্বারী মনির উদ্দীন (রহঃ) ফয়েজ ও তাওয়াজ্জুহ প্রাপ্ত একজন মহান ওলী। ওরাছাতুল আম্বিয়া বা পীর মাশায়েখদের আর্বিভাব জগৎবাসীর জন্য দুর্লভ স্পর্শ মনি স্বরূপ, আর পখিরার হযরতের মত একজন হক্কানী মহান ওলী যিনি ইসলাম প্রচার ও প্রসারে প্রায় শতাব্দী কাল চেষ্টা করেছেন। এ জন্য আমাদের উচিত তাঁর রূহানী ফয়েজ ও তাওয়াজ্জুহ লাভ করে নিজেদেরকে ধন্য করা। হযরত মাওলানা নূর মোহাম্মদ (রহঃ)-এর দেহে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রবাহিত ছিল ওলীর রক্তধারা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং উচ্চ স্তরের মুহাক্কেক আলেম। এই সঙ্গে যুক্ত হয় ছারছীনার কুতুব হযরত মাওলানা নেছার উদ্দিন (রহঃ) ফয়েজ ও তাওয়াজ্জুহ। অক্লান্ত সাধনা ও সীমাহীন ত্যাগের ফলে তরিকতের অতি উচ্চ মাকামে পৌছে যান তিনি। এভাবে শরীয়ত তরিকতের দুই ধারার অপূর্ব সম্মিলন এবং উভয় ধারায় উচ্চতর স্তরে পৌঁছার ফলে তিনি সত্যিকার নায়েবে নবীর মর্যাদা লাভ করেন এবং অশিক্ষা, অজ্ঞানতা, কুসংস্কার ও শিরক-বিদাতের অন্ধকারে নিমজ্জিত গোমরাহ জাতিকে পবিত্র ইসলামের আলোকোজ্জ্বল পথে নিয়ে আসার জিহাদে করেন নিজেকে উৎসর্গ। তাঁর হেদায়েতে দেশের দিকে দিকে ইলমে শরীয়ত ও তরিকতে আলো প্রজ্বলিত হতে থাকে। গোমরাহ লোকেরা পেতে থাকে সীরাতুল মোস্তাকিমের সন্ধান। পাপী-তাপী তওবা করে ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল হয়ে পরিণত হতে থাকে আল্লাহ ও রাসুলের আশেকে। লক্ষ লক্ষ মানুষ তার হেদায়েতে বাতিলের অন্ধকার থেকে সত্যের আলোতে উদ্ভাসিত হয়। তিনি দেশের বিভিন্ন এলাকায় বহু দ্বীনী প্রতিষ্ঠান ও কায়েম করেন। মাদারীপুর আহমদিয়া আলিয়া মাদ্রাসা তার সাধনায় কুতুব মিনার রূপে ছড়িয়ে যাচ্ছে কুরআন, হাদীস, তফসীর, আকাইদ, ফিকাহ্ তথা দ্বীনের সর্বোচ্চ ইলমের বিমল জ্যোতি।
মাদারীপুরের নূর পখিরার হযরত পীর সাহেব এর পিতা শাহসূফী হযরত মাওলানা ক্বারী শরীফ মোহাম্মদ মনিরউদ্দিন (রহঃ) ছিলেন আরব আজম খ্যাত ক্বারী, প্রখ্যাত আলিম ও চার তরিকার কামিল ওলী। গবেষণায় জানা যায় যে, পখিরার পীর সাহেবের পূর্ব পূরুষগণ সুদূর আরব থেকে ইসলাম প্রচার করতে বঙ্গদেশে এসেছিলেন। পখিরার হুজুরের প্রপিতামোহের জমিদারী ছিল বাকেরগঞ্জ জেলার কৃষ্ণকাঠী অঞ্চলে। জমিদারী প্রতিপালন ইবাদত বন্দেগীর ব্যাঘাত ঘটায় উপলব্ধি করে তিনি সব কিছু ত্যাগ করে অজানা ঠিকানার পথে পাড়ি জমান। অনেক জনপদ ঘুরে অবশেষে তিনি মাদারীপুর শহরের নিকটবর্তী গোবিন্দপুর এলাকায় বসবাস করতে থাকেন। পরবর্তীতে আত্মীয়-স্বজন তার অবস্থানের ঠিকানা অবগত হয়ে তাঁকে ফিরিয়ে নিতে আসে। তিনি সকলকে এই বলে বিদায় দেন যে, দুনিয়ার জমিদারী চিরস্থায়ী নয়। সামান্য ক’দিনের জন্য মিথ্যা এ প্রবঞ্চনার চেয়ে আল্লাহর ইবাদতে কাটানোই শ্রেয়। যা হোক, আপনজনদের সব অনুরোধ-দাবী উপক্ষো করে তিনি মাদারীপুরেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন এবং জনসাধারণের মাঝে ইসলামের বাণী প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। এখানেই তার ঔরসে জন্ম লাভ করেন জগদ্বিখ্যাত ক্বারী, আবেদ, আলেম, কামেল ওলী হযরত মাওলানা শরীফ মনিরুদ্দীন (রহঃ)। পিতার তত্ত¡াবধানে ইসলম শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি মক্কা-মদীনা গমন করেছিলেন উচ্চ শিক্ষা লাভের আশায়। তথায় হাজির হয়ে প্রথম তিনি ছহীভাবে কুরআন শিক্ষা শুরু করেন। অতঃপর তৎকালের বিশ্বখ্যাত আলিমদের নিকট তাফসীর হাদীস, ফিকাহ উলুম, বালাগাত মান্তিক, আরবী সাহিত্য প্রতৃতি ইসলামের বিভিন্ন শাখায় সর্বোচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। এরপর ইলমে মারিফত শিক্ষার জন্য কুতুবল হারামাইন কামিল অলী হযরত মাওলানা আব্দুল হক মুহাজেরে মক্কী (রহঃ)-এর হাতে বয়াত হন। কঠোর সাধনার দ্বারা মারেফতের সর্বোচ্চ জ্ঞান আত্মস্থ করেন। এভাবে সুদীর্ঘকাল পবিত্র মক্কা-মদীনায় অবস্থানের পর স্বীয় মুর্শিদের নির্দেশে দেশে ফিরে এসে দ্বীন প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তার দেশে আগমন ছিল একটি কারামত স্বরূপ। তিনি মুর্শিদের দরবার হতে বিদায় নিয়ে জেদ্দা এসে দেখেন, জাহাজ ছেড়ে গেছে। অতঃপর পীর সাহেবকে ব্যাপারটি জানালে তিনি একটি জ্বলন্ত মোমবাতির নিকট তাকে যেতে বললেন, দু’কদম হেঁটে তিনি নিজেকে স্বীয় বাড়ীতে উপস্থিত দেখতে পেলেন। এভাবে গত হয়ে যায় তার জীবনের ৬০টি বছর। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি বিবাহ শাদীর চিন্তা করার মত ফুসরৎ হয়নি, যা হোক, ৬০ বছর বয়সে এক আধ্যাত্মিক নির্দেশে তিনি এক সালেহা আবেদা নারীর পানি গ্রহণ করেন। ডাক্তারী মতে তখন তার সন্তান জন্ম দানের বয়স অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু আল্লাহর কুদরতে এ বয়সেই জন্ম গ্রহণ করেন মাদারজাত ওলী পীরে কামেল হযরত মাওলানা শরীফ নূর মোহাম্মদ (রহঃ)। মহান ওলীর ঘর আলোকিত করে আর এক ওলীর আগমন ঘটল পৃথিবীতে।
পখিরার হযরত পীর কেবলা যখন শিশু বয়স পেরিয়ে শিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত বয়সে পৌছেন তখন স্বীয় মুহতারম ওয়ালেদ কেবলা তাকে পবিত্র কুরআনের প্রথম ছবক দেন। এরপর পারিবারিক পরিমন্ডলেই চলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা। অতি অল্প বয়সে পবিত্র কুরআন ছহীহ রূপে শিক্ষা করেন। সাথে সাথে আরবী, উর্দু এবং ফার্সী ভাষাও তিনি আয়ত্ত করতে থাকেন। আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহ তাকে অসাধারণ স্মৃতিশক্তি দান করে ছিলেন বিধায় অল্পদিনের মধ্যে প্রাথমিক স্তরের কিতাবপত্র অধ্যয়ন সমাপ্ত করে মাধ্যমিক স্তরের কিতাবপত্র অধ্যয়ন শুরু করেন। ওয়ালেদে মুহতারাম মনে করলেন যে, পুত্রকে এখন শিক্ষা গ্রহণের জন্য কোন প্রতিষ্ঠানে যাওয়া উচিত। তাই তিনি স্বীয় বড় জামাতা মুহাক্কিক আলিম চট্টগ্রাম দারুল উলুম মাদ্রাসার হাদীসের উস্তাদ হযরত মাওলানা সুলায়মান (রহঃ)-এর নিকট পুত্রকে প্রেরণ করেন। এখানে কৃতিত্বের সাথে কিছুদিন অধ্যয়ন করার পর চট্টগ্রাম ত্যাগ করে তিনি ঢাকা এসে হাম্মাদিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখানেও কিছুকাল অধ্যয়ন করে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের লক্ষ্যে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তির জন্য তথায় গমন করেন। তখন কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া সহজ ব্যাপার ছিল না, তাছাড়াও তিনি হাম্মাদিয়া মাদ্রাসা থেকে কোন ছাড়পত্র নেননি। তৎকালীন ইংরেজ অধ্যক্ষের নিকট উপস্থিত হয়ে তিনি ভর্তির জন্য আবেদন জানালে অধ্যক্ষ সাহেব ভর্তি করতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিলেন। এরপর পীর কেবলা যখন তার কক্ষ থেকে বের হতে উদ্যত হন তখন অধ্যক্ষ সাহেব ভীত বিহবল কম্পমান কন্ঠে বললেন, হে বৎস! তুমি এখনই ভর্তি হয়ে যাও। আমি তোমাকে ভর্তি করে নিচ্ছি। পখিরার পীর কেবলা নিজে এ ঘটনাটি উলেখ করে মন্তব্য করেছিলেন যে, অধ্যক্ষ সাহেবের ভীত হওয়ার কারণ ছিল আমার ওয়ালেদ কেবলার রূহানী ফয়েজ ও কারামত। তিনি শুধু আমায় ভর্তি করেননি শুধু একই সাথে মাদ্রাসায় অধ্যায়নের ব্যাপারে তিনি অনেক সুযোগ সুবিধাও করে দেন, যা ছিল একজন বাঙ্গালী ছাত্রের জন্য দুর্লভ ব্যাপার।
যাহোক, তিনি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে তফসীর হাদীস তথা ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উচ্চ শিক্ষা অর্জনের ব্যাপৃত হন। অল্পদিনের মধ্যেই, স্বীয় মেধা মুখস্ত শক্তি, আদব-কায়দা ও চারিত্রিক গুনাবলীতে ছাত্র-শিক্ষক সকলের প্রিয় পাত্রে পরিণত হন তিনি। উস্তাদগণ তাকে অত্যন্ত ¯েœহ করতেন। মাদ্রাসার ওস্তাদগণ তার ইসলামী তাবাহহুর দেখে তাঁকে কিতাব কা কেরা বা কিতাবের পোকা উপাধিতে ভূষিত করেন। পাক-ভারত উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহঃ) তাঁকে দেখে একবার বলেছিলেন, “বাবা শরীফ নুর মোহাম্মদ তুমি ইচ্ছে করলে শ্রেণী কক্ষে প্রবেশ করে পাঠদান করতে পার। তোমার ইলমে শরীয়ত শেখার আর প্রয়োজন নেই। এ মন্তব্য একদিকে যেমন ছিল পখিরার পীর কেবলার শরীয়তের ইলমের সর্বোচ্চ শিক্ষা সমাপ্তির সনদস্বরূপ অন্যদিকে এ মন্তব্য ছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ আপাতত বন্ধ করে ইলমে শিক্ষাদানে আত্মনিয়োগ করার প্রচ্ছন্ন নির্দেশ সূচক। উস্তাদদের এ নির্দেশ সহজে হৃদয়াঙ্গম করতে পেরে পখিরার পীর কেবলা দেশে ফিরে আসেন এবং ইলমে শিক্ষাদানের ব্রতী হন।
পখিরার হযরত দেশে ফিরে এসে মাদারীপুরস্থ তাঁতীবাড়ী মাদ্রাসায় তখন তিনি শিক্ষকতা কার্যে রত ছিলেন। এ সময় খামারবাড়ীর পীর সাহেব-পখিরার পীরকে বলতেন, ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করুন, ইলমে তাসাউফ শিক্ষা ছাড়া জ্ঞান পূর্ণ হয় না।” এ সকল কথায় তাঁর মনে ভাবনার উদ্রেক হয়। ভেতর থেকে কে যেন তাঁকে চঞ্চল করে তোলে। এর কিছুদিন পূর্বের ঘটনা ছারছীনার পীর কেবলা (রহঃ) মোস্তফাপুর অঞ্চলে আগমন করেছিলেন এক মাহফিলের দাওয়াতে সেখানে পখিরার পীর কেবলা গমনপূর্বক ছারছীনা দরবারের মুফতী সাহেবের সাথে একটি মসআলা নিয়ে বাহাসে লিপ্ত হন। ঐ বাহাসে পখিরার পীর কেবলা যুক্তিতর্কে সফলতা অর্জন করেন। আর এ বাহাস চলাকালে ছারছীনার হুজুর (রহঃ) অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে দু’জনের যুক্তিতর্ক শ্রবণ করেছিলেন এবং পরিশেষে পখিরার পীর সাহেবকে ধন্যবাদও জানিয়েছিলেন। যাহোক, এর কিছুদিন পর ছারছীনার পীর কেবলা (রহঃ) খামার বাড়ী এক মাহফিলে আসেন। ঐ মাহফিলে পখিরার শরীফ নূর মোহাম্মদ (রহঃ) হুজুরকে ও দাওয়াত দেয়া হয়। মাহফিলে এসে তিনিও সকলে সাথে যিকিরে মশগুল হয়ে যান। কি আশ্চর্য কিছুক্ষণ যিকির করার পর তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। এরপর বেহুশ হয়ে পরে যান। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে এলে তিনি সোজা ছারছীনার হুজুরের সামনে হাজির হয়ে হাত বাড়িয়ে বয়াত গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আলোচনায় বলেছিলেন যে, আমি যখন যিকিরে বসলাম তখন ছারছীনার হুজুর কেবলা (রহঃ) এর যিকিরের তালীমের আওয়াজ আমার কানে আসতেই আমার কলব পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সাথে সাথে আমার ১০ লতিফা জারি হয়ে যায়, এর সাথে সাথে হুজুরের রূহানী তাওয়াজ্জুহ আমাকে দিশেহারা করে ফেলে, আমি বেহুশ হয়ে যাই। এরপর থেকে আমার চোখে ধরা দেয় এক নূরানী জগত।
অতঃপর পখিরার হুজুর স্বীয় মোর্শেদ ছারছীনা হুজুরের তত্ত¡াধবধানে চার তরীকায় কামালত অর্জন করেন। ফানা ফিশ শায়খ, ফানাফির রাসূল এবং ফানাফিলাহ-এর স্তরসমূহ অতিক্রম করে তিনি বাকাবিল্লাহ এর স্তরে উপনীত হন। ছারছীনার হুজুর, স্বীয় মুরীদ পখিরার হুজুরের মধ্যে মারেফতের পরিপূর্ণতা উপলদ্ধি করে তাকে খেলাফত দান করেন। জানা যায় যে, ছারছীনার হুজুর কেবলা (রহঃ) ফরিদপুর অঞ্চলের সকল ভক্ত মুরীদ ও খলীফাদের দাওয়াত দিয়ে হাজির করা হয়েছিল। সেখানে তালিম দানের এক পর্যায়ে ছারছীনার পীর কেবলা তাঁর পাশে কম্বল মুড়ি দিয়ে মোরাকাবায় রত পখিরার পীর সাহেবকে বলা কে হাত ধরে নিজের পাশে দাঁড় করিয়ে উপস্থিত সকলকে বলে দিলেন, এই মাওলানা নূর মোহাম্মদ চার তরীকার কামিল, উনি মস্ত বড় ওলী-আমি এ অঞ্চলের জন্য তাঁকে খলীফা নিযুক্ত করলাম। এভাবে খিলাফতপ্রাপ্ত হয়ে পখিরার পীর সাহেব (রহঃ) পূর্বের চেয়ে আরো অধিক পরিশ্রম করে জনসাধারণের মাঝে দ্বীন প্রচার করতে থাকেন। মানুষকে শিরক বিদআত থেকে ফিরিয়ে আনতে তিনি আজীবন কঠোর প্রচেষ্টা চালান।
তিনি দেশের প্রতিটি অঞ্চলে তিনি সফর করেছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি অসংখ্য মসজিদ মাদ্রাসা, খানকা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি মানুষকে বেশী বেশী করে যিকির করতে নির্দেশ দিতেন। তিনি বলতেন, যিকিরে দিলে নূর পয়দা হয়। আর নূর পয়দা হলেই তো বান্দার সবকিছু এছলাহ হয়ে যায়। তিনি বেপর্দেগী একদম সহ্য করতে পারতেন না। তিনি মুরীদদেরকে কঠোর পর্দা মেনে চলার নির্দেশ দিতেন। পখিরার পীর কেবলা চরিত্র গুণে ছিলেন একজন আদর্শ মানুষ। চলনে-বলেন কথায় কাজে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নবীজী (সাঃ) এর সুন্নতের অনুসারী। আপন-পর সকলের সাথে তিনি হাসি মুখে কথা বলতেন। কথায় যেন তার যাদু ছিল। একবার যে তার নিকটে পৌছেছে সে আর জীবনে দূর হতে পারেনি। এমনিক বিধর্মীরা পর্যন্ত তাকে ভালবাসতো, সম্মান করতো। স্বীয় পীরের প্রতি তাঁর ভক্তি ও আদব ছিল দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি বলতেন, একজন সত্যিকারের পীর, আলার ওলীর সবচেয়ে বড় কারামত হল তিনি ফরজ, ওয়াজেব, সুন্নাত, মুস্তাহাব যথাযথভাবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মেনে চলবেন। তার এ কথার আলোকে দেখা গেছে যে, তিনি ছিলেন নূর নবী (সাঃ)-এর ওসওয়াতুন হাসানার পূর্ণ পাবন্দ। পখিরার পীর কেবলা স্থায়ীভাবে ইসলাম প্রচারের জন্য স্বীয় বাড়ীতে ১৯৪৯ সালে আহমদিয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। শত শত ছাত্র সেখানে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে দ্বীনের আলো বিতরণ করে চলেছে। তিনি ছিলেন প্রকৃত আশেকে রাসূল (সাঃ) তিনি যিকিরের পরে সব চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতেন দরুদ পাঠের। মদীনা যাওয়ার জন্য সর্বদা তার হৃদয় ছটফট করতো। তিনি প্রত্যেকটি মুনাজাতে বিশেষত তাহাজ্জুত নামাজ বাদ চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে যে দীর্ঘ মুনাজাত করতেন তার শেষ তিনি সর্বদা একটি নাতের দুটি পংক্তি আবৃত্তি করতেন যথা-“মুঝে বোলা লেও ইয়া রাসূলুল্লাহ” যুবক বয়স থেকেই বাইতুলাহর হজ্জ ও নবীজী (সাঃ)-এর রওজা যিয়ারতের উদগ্র আকাংখা পোষণ করতেন হৃদয়ে। তাই দেখা যায়, শত ব্যস্ততাকে উপেক্ষা করে তিনি ৮ বার পবিত্র হজ্জব্রত ও যিয়ারতে গমন করেছেন। সর্বপ্রথম তিনি হজ্জ সমাপন করেছিলেন স্বীয় মোজাদ্দিদে কুতুবুল এরশাদ হযরত মাওলানা নেছার উদ্দিন (রহঃ) এর সংগী হয়ে। এ হজ্জব্রত ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৩৫৬ সালে ছারছীনার পীর কেবলা (রহঃ) নিজের জীবনের সম্ভবত (শেষ) হজ্জের ঘোষণা দেন এবং বিশেষ ব্যবস্থায় স্বীয় ১৪০১ জন বিশিষ্ট খলীফা নিয়ে পবিত্র হজ্জ সম্পাদন করেন। এ হজ্জ যাত্রায় পখিরার পীর কেবলা তাঁর প্রতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিশেষ অনুগ্রহের বহু চিহ্ন উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন।
পখিরার পীর কেবলা ছিলেন একজন কামিল ওলী। সফরে কি বাড়ীতে, সুস্থ কি অসুস্থ কোন অবস্থায়ই তিনি তার নৈমিত্তিক যিকির আযকার, মোরাকাবা-মোশাহাদা এবং ওজিফা আদায়ের কোন ব্যত্যয় ঘটত না। তিনি প্রতিদিন রাত দ্বি-প্রহরের পরক্ষনেই ঘুম থেকে জেগে যেতেন। এরপর তাহাজ্জদ নামাজে দাঁড়াতেন-দেড় ঘন্টা সময় নিয়ে ৪/৬ রাকাত কখনও বেশী তাজাজ্জদ আদায় করতেন, অতঃপর দোয়া-দরুদপড়ে মোনাজাতে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাতেন। অতঃপর ফজর হলে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করে যিকির তালিমে মগ্ন হতেন। এরপর এশরাক মোরাকাবা, চাশত আদায় করে কিছু নাস্তা খেয়ে মাদ্রাসার দেখাশুনা লোকজনের সাথে আলাপ ইত্যাদি করতেন। মাগরিব নামাজ বাদ এশা পর্যন্ত যিকির আযকার তালিম তরবিয়াত, মোরাকাবায় কাটাতেন, এশা বাদ তিনি বিশ্রামে চলে যেতেন। মৃত্যু পর্যন্ত ব্যতিক্রম ঘটেনি এ রোজনামচার। হুজুরের বিশেষ খাদেম মাদারীপুর নিবাসী মাওলানা ইউসুফ বলেন যে, আমি ৩৩ বছর পর্যন্ত এক নাগাড়ে হুজুরের সান্নিধ্যে ছিলাম। কিন্তু কোন দিন তাকে তাজাজ্জুদ নামাজ ছেড়ে দিতে দেখিনি। সুবহানালাহ কারামতুল আওলিয়া হাক্কুন আওলিয়াগানের কারামত সত্য। তাই কামিল ওলী পখিরা পীর কেবলার জীবনেও অনেক কারামত প্রকাশ পেয়েছিল। ৮০ দশকের ঘটনা হুজুর খুলনা জেলার গৌরম্ভা গ্রামে মাহফিলে উপস্থিত হয়েছেন। ঐ এলাকার জনৈক মোকাম্বের-এর একজন ভাগ্নি ছিল বোবা। হুজুরকে অনেক অনুরোধ জানান হল তাঁকে একটু ফুঁদিয়ে দিতে। যাতে করে তার যবান খুলে যায়। হুজুর বললেন, আমি মেয়েদেরকে সম্মুখে আনা পছন্দ করি না। অতঃপর মোকাম্বেরকে হা করিয়ে তার মুখে ফুঁদিয়ে বললেন, এবার তুমি তোমার ভাগ্নির মুখে ফুঁ দাও। নির্দেশমত তৎক্ষণাৎ মোকাম্বের ঘরে প্রবেশ করে ভাগ্নিকে হা করিয়ে মুখে ফুদিতেই সাথে সাথে তার যবান খুলে গেল। স্বাভাবিকভাবে কথা বলা শুরু করল। প্রধান শিক্ষক মোঃ আব্দুল হাই সাহেব বলেন-১৯৭৫ সালের কথা। আমাদের এলাকায় বৃষ্টি হচ্ছিল না। দুবর্বা ঘাস পর্যন্ত পুড়ে ছাই হয়ে গিয়ে ছিল। বৃষ্টির জন্য মানুষ পাগল প্রায়। এলকার লোকজন পখীরার পীর সাহেব কেবলাকে দাওয়াত দিয়ে আনল। ১০টার সময় এস্তেগফার নামাজ পড়া শুরু হলো। নামাজের পর হুজুরের সাথে আমরা হাত উঠাই। মোনাজাতের মধ্যেই মেঘের ডাক শোনা গেল। মোনাজাত শেষ হতে না হতেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। এলাকাবাসী আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। এভাবে অসংখ্য কারামত তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশ পেয়েছিল হুজুরের শতাব্দীকাল ব্যাপী জীবনে।
মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তিনি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে তাকে মাদারীপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে ঢাকার ইস্কাটনে ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এভাবেই অসুস্থ অবস্থায় ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ রোজ শনিবার বেলা ২টায় অসংখ্য ভক্ত-মুরীদানকে শোক-সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে জান্নতবাসী হয়। মৃত্যুকালে হুজুরের বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। পখিরার হযরতের প্রথম নামাজে জানাজা হয় ঢাকার গাউসুল আজম মসজিদে অতঃপর ১৫ তারিখ হুজুরের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসার ময়দানে হাজার হাজার ভক্ত-মুরীদের উপস্থিতিতে ২য় বার জানাজার নামাজ আদায় করা হয়। এ জানাজার ইমামতি করেন আমীরে হিযবুলাহ ছারছীনা আলহাজ্জ হযরত মাওলানা শাহ মুহাম্মদ মহিবুবলাহ পীর সাহেব কেবলা। হুজুরের ইন্তিকাল সংবাদে সমগ্র দেশে বিশেষতঃ আলেম সমাজে নেমে আসে শোকের ছায়া। ফুরফুরা দরবার শরীফ, ছারছীনা দরবার শরীফে বিশেষ দোয়া হয়। ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে নিবেদিত প্রান শরীয়ত ও মারেফতের অতি উচ্চ স্তরের মহান ওলী এই মর্দে মুজাহিদের স্থান পূরণ হওয়ার নয়। পখিরার পীর ছাহেরব ছিলেন অলিয়ে কামেল, মুহাক্কিক আলেম, সমাজ সংস্কারক এক মহান ব্যক্তিত্ব আধ্যত্মিকতার উচ্চস্তরের এই ওলী-আলার দ্বারা লক্ষ লক্ষ মানুষ সৎ পথের সন্ধান পেয়েছেন। আল্লাহপাকের এ মহার ওলীর রূহানী ফয়েজ আমাদের নসীর করুন।(আমীন)
Add Comment