মেট গালা অভিষেক। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সময়, প্ল্যাটফর্ম আর প্রজন্ম পেরিয়েও শাহরুখ খান রয়ে গেছেন অমলিন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরও ভাইরাল হয়ে উঠছেন বলিউড বাদশা শাহরুখ খান। আজ তার ৬০কম জন্মদিন। অভিনন্দন বাদশা। তিনি সব শ্রেণির মানুষের ভালবাসা অর্জন করেছেন। অভিনয় দক্ষতায় জেনারেশন জেড বা জেন জি’র কাছেও তিনি সমান গ্রহণযোগ্য। তারা তাকে রিমিক্স করে। মিলেনিয়ালরা তার সঙ্গে বড় হয়েছে। বেবি বুমাররা দেখেছে তার উত্থান। ভারত এবং ভারতের বাইরে কোটি কোটি মানুষের কাছে শাহরুখ খান (এসআরকে) আজও হিন্দি সিনেমার অন্যতম পরিচিত ও প্রভাবশালী মুখ। আজ তিনি ৬০ বছর পা দিলেন। এই অভিনেতা নানা ভাইরাল মুহূর্তের জন্ম দিয়েছেন।
মে মাসে তিনি প্রথম ভারতীয় পুরুষ অভিনেতা হিসেবে মেট গালার রেড কার্পেটে হেঁটেছেন। জুনে এড শিরানের ‘স্যাফায়ার’ গানে একটি বিশেষ উপস্থিতি দিয়েছেন। আর অক্টোবরে দক্ষিণ কোরিয়ার স্কুইড গেম তারকা লি জং-জায়ের সঙ্গে রিয়াদে একটি সেলফিতে ভাইরাল হয়েছেন। ভক্তরা সেটাকে বলেছেন ‘শতাব্দীর সেরা কোলাব’। গুগল ট্রেন্ডস দেখাচ্ছে, তার জনপ্রিয়তা মরিশাস থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। প্রশ্ন হলো- কীভাবে তার ‘মিথ’ সময়, দেশ, প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে আজও টিকে আছে?
মিথের আড়ালের মানুষ: ১৯৯২ সালে আত্মপ্রকাশের পর শাহরুখ খান এ পর্যন্ত ৮০টিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি ছিলেন প্রেমের প্রতীক ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’ (১৯৯৫)তে- যা আজও মুম্বাইয়ের একটি সিনেমা হলে চলছে। তিনি ছিলেন একজন লাঞ্ছিত হকি কোচ, মুক্তির সন্ধান করছেন ‘চক দে! ইন্ডিয়া’ (২০০৭)-তে। আর সাম্প্রতিক ‘জওয়ান’ (২০২৩)-এ তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী নায়ক। সেখানে তিনি ছয়টি ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন, প্রতিটি তাঁর পূর্বের চরিত্রগুলির প্রতিধ্বনি। এই ছবির জন্যই তিনি সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান পান। জার্মান ভাষার বলিউডমুখী ম্যাগাজিন ইশক-এর প্রধান সম্পাদক ভেরা ওয়েসেল বলেন, এসআরকে এমনভাবে আবেগ জাগাতে পারেন, যা অন্য কোনো অভিনেতার পক্ষে সম্ভব নয়। এমনকি তার ভক্তরাও ব্যাখ্যা করতে পারেন না কেন তার এমন প্রভাব। একবার মার্কিন টিভি হোস্ট ডেভিড লেটারম্যানকে তিনি মজা করে বলেছিলেন, আমি শাহরুখ খানের মিথের একজন কর্মচারী।
ভক্তদের চোখে শাহরুখ: অর্থনীতিবিদ ও শাহরুখপ্রেমী শ্রেয়না ভট্টাচার্য তার বই ‘ডেমপারেটলি সিকিং শাহরুখ খান’ (২০২১)-এ নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে শাহরুখের মিথকে বিশ্লেষণ করেছেন। তার মতে, শাহরুখ খান এমন এক প্রতীক, যার মাধ্যমে ভারতীয় নারীরা- বিভিন্ন বয়স, শ্রেণি, অঞ্চল ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে- নিজেদের আকাক্সক্ষা, হতাশা ও স্বাধীনতার অনুসন্ধানকে ব্যক্ত করেছে। একজন অভিবাসী গৃহকর্মীর কাছে শাহরুখের পর্দায় পরিবারের কাজে সাহায্য করা বা কোমল আচরণ ছিল বিরল স্বীকৃতি- এমন দেশে যেখানে পুরুষদের ‘কেয়ার লেবার’-এ অংশগ্রহণ বিশ্বের অন্যতম কম। উচ্চবিত্তদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় উদার অর্থনীতির মেধার প্রতীক। আর প্রথম প্রজন্মের নারী পেশাজীবীদের জন্য তার সিনেমা ছিল সামাজিক চাপে দমে যাওয়া আত্মার প্রশান্তি- যারা বিবাহের বদলে ক্যারিয়ার বেছে নিয়েছিলেন।
শ্রেয়না ভট্টাচার্য বলেন, ১৫ বছর ধরে আমি তার নারীভক্তদের জীবন, ভালোবাসা ও কর্মজীবন অনুসরণ করেছি। আমি জানি শাহরুখ খানকে ঘিরে একক কোনো তত্ত্ব দেওয়া অসম্ভব- প্রত্যেকে তার ওপর নিজেদের আলাদা স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা আর কল্পনা প্রতিফলিত করেছে।
জেনারেশন জেডের রিমিক্সে: ‘৯০-এর দশকের বয়ব্যান্ডগুলির মতো, শাহরুখের ভক্তরাও সময়ের সঙ্গে বেড়ে উঠেছেন- অনেকেই তাদের সন্তানদের মধ্যেও সেই ভালোবাসা ছড়িয়ে দিয়েছেন। তার প্রবাসী ভারতীয় চরিত্রগুলো ৩.৫ কোটি ভারতীয় প্রবাসীর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করেছে এবং অনেক বিদেশি দর্শককেও হিন্দি সিনেমায় টেনেছে। ভেরা ওয়েসেল বলেন, ভারত এখন বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশ ও বিশাল বাজার। শাহরুখ খানের তারকাখ্যাতি ছড়াতে আলাদা প্রচেষ্টা লাগে না। তিনি যোগ করেন, এড শিরানের মতো শিল্পীদের পক্ষে শাহরুখের সঙ্গে কাজ করা কেবল স্বাভাবিক নয়, বুদ্ধিদীপ্তও। এখনকার তরুণ প্রজন্মের কাছেও শাহরুখ খান ‘মিম’, ‘টিকটক’ ও ‘রিমিক্স’-এর ভাষায় বেঁচে আছেন।
তার বিখ্যাত গান ও হাত মেলানো, বাহু মেলে ধরা ভঙ্গি নতুন করে ভাইরাল হচ্ছে। কানাডীয়-ভারতীয় র্যাপার টেশারের ‘ইয়াং শাহরুখ’ গানটি, যা ‘কভি খুশি কভি গম’ (২০০১)-এর একটি গান থেকে নেয়া, ইউটিউবে ২ কোটির বেশি ভিউ পেয়েছে । আর শাহরুখ নিজেও সেই গানে নেচেছেন। বৃটিশ গায়িকা দুয়া লিপার ‘লেভিটেটিং’ গানটি মেশানো হয়েছিল শাহরুখের ‘বাদশাহ’ (১৯৯৯)-এর ‘ও লাড়কি যা’ গানের সঙ্গে, যা তিনি মুম্বইয়ে লাইভ কনসার্টে পরিবেশন করেন। দর্শকদের মধ্যে ছিলেন শাহরুখের মেয়ে সুহানাও, যিনি সেই মুহূর্তটি ইনস্টাগ্রামে হৃদয়চিহ্নসহ পোস্ট করেন।
সময়ের ওপারে এক আইকন: ভেরা ওয়েসেল মনে করেন, শাহরুখ খানের স্থায়ী প্রভাবের পেছনে তার অসাধারণ ব্যবসায়িক বুদ্ধি আছে। তিনি ছিলেন প্রথম দিকের ভারতীয় তারকাদের একজন, যিনি অনলাইনে ভক্তদের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তুলেছিলেন। ইনস্টাগ্রামে তার ৪৮.৮ মিলিয়ন অনুসারী আছে, যেখানে তিনি নিয়মিত বড় বড় ব্র্যান্ডের প্রচারণা করেন। ওয়েসেল বলেন, তিনি যখনই কথা বলেন- সিনেমায় হোক বা প্রকাশ্যে- সবসময় আশার বার্তা দেন, সরল ভাষায়, রসিকতার ছোঁয়ায়। আর তার মতে, ফ্যাশন ও ট্রেন্ড বদলায়, কিন্তু শাহরুখ খানের জনপ্রিয়তা একদম কালজয়ী।










Add Comment