বেহেস্তী, স্টাফ রিপোর্টার ::
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর হিউস্যান রাইটস মুভমেন্ট-সিএইচআরএম-উদ্যোগে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে ১৫/০৭/২০২৫, সকাল ১০.০০ টায় কাকরাইল মোড়ে।
লোমহর্ষক একটি হত্যাকাণ্ডে স্তব্ধ পুরো দেশ। বিচারের দাবিতে ক্ষোভ-বিক্ষোভ সর্বত্র। মানুষের মুখে মুখে প্রশ্ন কেন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এর কারণই বা কী? কীভাবে ঘটেছে এই হত্যাকাণ্ড। মানবজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে জানার চেষ্টা করেছে এসব প্রশ্নের উত্তর। অন্যান্য ‘দিনের মতো গত বুধবার মিটফোর্ডের রজনী বোস লেনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সোহানা মেটালে অবস্থান করছিলেন ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ (৩৯)। তখনও ওই লেনের বায়তুল ফালাহ মসজিদে নামাজ পড়ে বের হচ্ছিলেন আশপাশের ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা। মসজিদের পাশের ভবনের নিচতলায় সোহাগের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সাড়ে ৫টার কিছু পরে ২৫/৩০ জন ব্যক্তি একসঙ্গে সোহানা মেটালের সামনে গিয়ে ‘ধর ধর’ বলে সোহাগের ওপর হামলা চালায়। সবাই হায়েনার মতো একসঙ্গে কিল, ঘুষি, লাথি দিতে দিতে সোহাগকে নিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের দিকে চলে যায়। সেখানে গিয়ে মারতে মারতে হাসপাতালের তিন নম্বর গেটের ছোট পকেট গেট দিয়ে তারা সোহাগকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। সেখানেও বেধড়ক পেটানো ও কোপানো হয়। পাথর দিয়ে নৃশংসভাবে মাথা থেঁতলে দেয়া হয়। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও অর্ধনগ্ন লাশের উপর উঠে উল্লাস করে খুনিরা। প্রথমদিকে ঘটনা তেমন জানাজানি না হলেও দু’দিন পর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ভিডিওতে সোহাগকে মারার নৃশংস বর্বরতা দেখে আঁতকে ওঠে মানুষ। পাশবিক ওই ঘটনা দেখে নিন্দা ও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবি করে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। দেশব্যাপী প্রতিবাদ, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে চাঁদাবাজির কোনো ঘটনা নাই। বরং ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কারা বসবে না বসবে এবং কিছু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
নির্মম হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কী: নিহত সোহাগ মিটফোর্ড এলাকায় ভাঙাড়ি ব্যবসার সঙ্গে পুরনো বৈদ্যুতিক সাদা তার কেনাবেচার ব্যবসা করতেন। সোহানা মেটাল নামে মিটফোর্ড এলাকার চায়নাপট্টি ও রজনী বোস লেনে তার দুটি দোকান রয়েছে। নিহত সোহাগ এবং মহিন পূর্বপরিচিত ছিলেন। ওই এলাকায় বিদ্যুতের তামার তার ও সাদা তারের ব্যবসার একটা সিন্ডিকেট রয়েছে। তামার তার ও সাদা তারের অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া ছিল মহিন, অপু, টিটু, যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সহ-জলবায়ু বিষয়ক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক রজ্জব আলী পিন্টুসহ মিটফোর্ড হাসপাতালের একটি চক্র। তারা অবৈধ বাণিজ্যের ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিল। তা না হলে নিয়মিত মাসে ২ লাখ টাকা চাঁদা দেয়ার দাবি জানিয়েছিল তারা। এই দ্বন্দ্বের জেরে সোহাগের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গুলিও করে দুর্বৃত্তরা। এর পরে তিনদিন সোহাগ দোকান খুলেনি।
মহিন-অপুর নেতৃত্বে চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট: সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যার নেতৃত্বদানকারী যুবদলের বহিষ্কৃত নেতা মাহমুদুল হাসান মহিন এবং একই থানা ছাত্রদলের বহিষ্কৃত নেতা অপু দাসের ছত্রছায়ায় মিটফোর্ড এলাকায় চাঁদাবাজির ভয়ঙ্কর এক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। স্থানীয় ওষুধ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী, ফুটপাথ, সব জায়গায় চাঁদাবাজি চলতো। তারা দু’জনের নেতৃত্বে ৫ই আগস্টের পর থেকে মিটফোর্ড ও পাশের এলাকায় প্রকাশ্য চাঁদাবাজি হতো। চাঁদাবাজিতে সক্রিয় ছিল ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা দাবি করা অনেকে। তাদের ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতো স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। কারণ চাহিদামতো টাকা না দিলে আর চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ব্যবসায়ীদের মারধর করা হতো। প্রকাশ্যে অস্ত্র বের করে হুমকি দেয়া হতো। চাঁদা না দিলে দোকান বন্ধ করে দেয়া হতো। কেউ চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করলে তাকে নির্যাতন করা হতো। থানা পুলিশ এসব চাঁদাবাজির বিষয়ে জানলেও নীরব থাকতো। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, মিটফোর্ড এলাকায় চাঁদাবাজির ভাগ বিভিন্ন স্তরে ভাগবাটোয়ারা হতো। এজন্য এসব বিষয় জানাজানির পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হতো না। স্থানীয়রা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই চকবাজার ও মিটফোর্ড এলাকায় সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন মহিন ও অপু দাস। বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন ব্যবসায়ীরা। ফুটপাথ দখল করে দোকান থেকে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে হুমকি দিয়ে চাঁদা তোলা ছিল তাদের নিত্যদিনের কাজ। যারাই চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানাতেন তাদেরই মারধর করা হতো এবং দোকান বন্ধ করে দেয়া হতো। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, সোহাগকে হত্যার কয়েকদিন আগেও এক এম্বুলেন্স ব্যবসায়ীকে চাঁদার জন্য সবার সামনে বেধড়ক মারধর করেন মহিন ও অপু দাস।
ভিডিওতে যা দেখা গেল: মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর ফটকের সামনে নিহত সোহাগের প্রায় বস্ত্রহীন রক্তাক্ত দেহ ফটকের ভেতর থেকে টেনে বের করতে দেখা যায় দুই যুবককে। এর মধ্যে একজন তার গালে চড় মারছে, আরেকজন এসে ওই ব্যক্তির বুকের ওপর লাফাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর আরেকজন এসে একইভাবে লাফাচ্ছিল। আবার কেউ এসে তার মাথায় লাথি মারছিল। আকাশি রঙের শার্ট ও জিন্সের প্যান্ট পরা রিয়াদ একটি বড় কংক্রিটের অংশ হাতে তুলে সজোরে সোহাগের বুকের মাঝখানে আঘাত করে। টি-শার্ট আর গ্যাবাডিন প্যান্ট পরা সজীব একপাশ থেকে হেঁটে এসে আরেকটা বড় কংক্রিটের অংশ মাথায় তুলে মুখ বরাবর আঘাত করে। এরপর আরেকটি ইট নিয়ে এসে মাথায় আঘাত করে ছোট মনির। পাশ থেকে আবার মাথায় আঘাত করে লম্বা মনির, আর এদের ইট এগিয়ে দেয় নান্নু। একপর্যায়ে লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে মিটফোর্ড হাসপাতাল চত্বরেই পিটিয়ে ও ইট-পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। শুধু হত্যা করেই থেমে থাকেনি সন্ত্রাসীরা। সোহাগের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও লাশের ওপর চলতে থাকে নৃশংসতা। রক্তাক্ত নিথর দেহটি রাস্তার মাঝখানে ফেলে লাশের ওপর দাঁড়িয়ে চলে ভয়াবহ উন্মত্ত উল্লাস। একজন নয়, একাধিক যুবক লাশের নাক-মুখে এবং বুকের ওপর একের পর এক আঘাত করে যেতে থাকে। এরপর নিথর দেহ টেনেহিঁচড়ে কম্পাউন্ডের বাইরের সড়কে এনে শত শত মানুষের সামনে চলে উন্মত্ততা। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া ছোট মনির মিটফোর্ড হাসপাতালের আউটসোর্সিং কর্মচারী, নান্নু হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার। বড় মনির, রিয়াদ ও সজীব যুবদল নেতা মহিনের কর্মী।
কেউ এগিয়ে আসেনি: প্রকাশ্যে শত শত লোকের সামনে এ নৃশংস ঘটনা ঘটলেও সোহাগকে রক্ষায় এগিয়ে আসেনি কেউ। ভয়ে কেউ ঘটনা নিয়ে মুখ খুলছেন না। মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর ফটকের ঠিক সামনেই রয়েছে শাহিদা মেডিকেল ফার্মেসি, নেওয়াজ ফার্মেসি ও মনোয়ারা ম্যানশন। তাদের সামনে এ হত্যাকাণ্ড ঘটলেও কেউ এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুখ খুলছেন না। ওইদিন ডক্টরস ক্লিনিক অ্যান্ড হাসপাতাল ভবন থেকে অনেকে ভিডিও করলেও ভয়ে এ নিয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন এ ঘটনা ঠিক আনসার ক্যাম্পের সঙ্গে হলেও আনসার সদস্যরা এগিয়ে আসেনি। সরজমিন গিয়েও এ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গিয়েছে। সরজমিন দেখা যায়, হাসপাতালটির ৩ নম্বর ফটক ঘেঁষে রয়েছে আনসার ক্যাম্প।
আনসার সদস্যরা ঘটনাস্থলের পাশে থাকলেও ওইদিন এগিয়ে যায়নি। এ নিয়ে কয়েকজন আনসার সদস্যের কাছে থেকে জানতে চাইলে তারা বলেন ওইদিন তারা এখানে ছিলেন না। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, নিহত সোহাগ তিন মাস আগে রজনী বোস লেনে দোকান নেন। চায়না পট্রিতে তার আরেকটি দোকান রয়েছে। গত বুধবার বিকালে ২৫-৩০ জন যুবক এসে সোহাগকে রজনী বোস লেনের দোকান থেকে মারতে মারতে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। সে নিয়মিত দোকানে থাকতো না তার কর্মচারীরা দোকানে বসতো। আরেক ব্যবসায়ী বলেন, বুধবার বিকাল বেলায় আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম হঠাৎ দেখি একজন লোককে কয়েকজন মিলে মারছে। আমি ভয়ে পাশের গলিতে ঢুকে পড়ি।
প্রকাশ্যে এ ঘটনা ঘটলেও ভয়ে আমরা কেউ আগাতে পারিনি। তারা অস্ত্র নিয়ে এসেছিল ভয়ে ছিলাম প্রতিবাদ করলে আমার ওপর যদি হামলা হয়। হত্যার পর তারা লাশ রাস্তার উপর ফেলে রেখেছিল। পরে পুলিশ-সেনাবাহিনী এসে লাশ নিয়ে যায়। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ঘটনা ঘটেছে বুধবার অথচ সবাই খবর পেয়েছে শুক্রবারে। ওইদিন মিডিয়াকে কেন জানানো হয়নি? রাস্তায় অনেক মানুষ থাকলেও প্রকৃত পক্ষে হামলার আশঙ্কায় এগিয়ে আসেনি। সাধারণ মানুষ বাদ দিন এখানে তো আনসার ক্যামপ ছিল তারা কেন এগিয়ে আসেনি? আরেক ফার্মেসি ব্যবসায়ী বলেন, গত বুধবার বিকাল বেলায় কিছু লোক দেখি নিহত সোহাগকে মারছে। ভয়ে আমরা কেউ কাছে যাইনি।
একপর্যায়ে সোহাগকে পিটিয়ে ও ইট-পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে নৃশংসভাবে হত্যা করে। শুধু হত্যা করেই থেমে থাকেনি সন্ত্রাসীরা। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর লাশের উপর তারা উল্লাস করতে থাকে। হত্যার পর তারা রাস্তার উপর অনেকক্ষণ লাশ ফেলে রাখে। ঘটনাস্থলে অনেক মানুষ থাকলেও আতঙ্কে ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। এখন বক্তব্য দিলে পরবর্তীতে তার ওপর হামলা হবে না এমন কোনো নিশ্চয়তা আছে? নিহতের বোন মঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, আমার ভাই ছোটবেলা থেকেই ঢাকায় বসবাস করে আসছে। ২০১৮ সাল থেকেই সে ভাঙ্গাড়ি ব্যবসা করে আসছে। তার দু’টি দোকান রয়েছে এর মধ্যে একটি দোকান গত তিন মাস আগে নিয়েছিল। আমার ভাইয়ের পরিচিত লোকজনই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তিনি বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে সমপৃক্ত ছিলেন। খুনিরা আমার ভাইয়ের কাছে ২ লাখ টাকা এবং ব্যবসার লাভের ৫০ শতাংশ দাবি করে। চাঁদা না দেয়ায় আমার ভাইকে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করে। আমরা এ হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই।
আমার বাবার হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই: বাবাকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় জড়িত সব আসামির ফাঁসি দাবি করেছে নিহত সোহাগের ১৪ বছরের মেয়ে সোহানা ও ১১ বছরের ছেলে সোহান। অশ্রুশিক্ত হয়ে তারা বলেন, আমাদের বাবা এমন কী দোষ করেছিল? যে তাকে এইভাবে পাথর দিয়ে থেঁতলে হত্যা করা হলো। মৃত্যুর পরও আমার বাবা ছাড় পায়নি। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই। গতকাল সরজমিন নিহত সোহাগের কদমতলী মডেল টাউনের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বাসায় কেউ নাই। দরজায় তালা মারা। আশপাশের লোকজন জানায়- সোহাগের লাশ নিয়ে তার পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা গ্রামের বাড়ি বরগুনায় গিয়েছেন। পরে সোহাগ হত্যাকাণ্ডের বাদী ও নিহত সোহাগের ছোট বোন মঞ্জুয়ারা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি মানবজমিন’কে বলেন, পরিকল্পিতভাবে আমার ভাইকে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এমন হত্যাকাণ্ড মনে হয় আর কেউ আগে দেখেনি। কীভাবে আমার ভাইকে পাথর দিয়ে ইট দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মৃত্যুর পরও তার লাশের উপর লাফানো হয়েছে। কতোটা কষ্ট আমার ভাইকে দেয়া হয়েছে। এমন কষ্ট যেন আর কোনো ভাইয়ের বোন না পায়। এসব কথা বলতে বলতে অঝোরে কান্না করছিলেন মঞ্জুয়ারা বেগম। তিনি বলেন, আমার ভাই দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে আগে লালবাগ এলাকায় বসবাস করতো। বর্তমানে কদমতলী মডেল টাউনে থাকতো।
সেদিন (বুধবার) হত্যার পর পুলিশ আমার ভাইয়ের লাশ নিয়ে যায়। বৃহস্পতিবার আমরা লাশটি পাই। ওই দিনই আমি, আমার ভাবি (নিহত সোহাগের স্ত্রী), ভাতিজি-ভাতিজাসহ সকলে গ্রামের বাড়ি বরগুনায় চলে আসি। তিনি বলেন, আমার মা আলেয়া বেগম ও বাবা আইয়ুব আলী অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। আমার মাকে আমাদের নানিবাড়ি বরগুনার ৭নং ধলুয়া ইউনিয়নের বান্দরগাছি গ্রামে দাফন করা হয়। মাকে দাফনের সময়ই আমার ভাই বলেছিল- তার যদি কখনো মৃত্যু হয় তাকেও যেন নানিবাড়ি আমাদের মায়ের পাশেই দাফন করা হয়। সেই কথামতোই শুক্রবার বান্দরগাছি গ্রামে আমার ভাইকে দাফন করা হয়েছে। আমার ভাবি, ভাতিজি, ভাতিজা সকলেই এখানে (বরগুনায়)। দুই-একদিনের মধ্যেই আমরা সকলেই ঢাকায় ফিরবো। তিনি বলেন, এতো বড় একটা নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চলানো হলো তারপরও মাত্র হাতেগোনা কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদেরকে এখনো আটক করা হয়নি। আমরা চাই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সকলকে যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়। যারা আমার ভাইকে এইভাবে নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাদের প্রত্যেকের যেন সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি দেয়া হয়। এ সময় নিহত সোহাগের ১১ বছরের ছোট্ট ছেলে সোহান বলে, আমার বাবাকে কীভাবে মারা হয়েছে। কীভাবে তাকে পাথর দিয়ে আঘাত করে করে হত্যা করা হয়েছে। এমন কষ্ট দিয়ে কেউ কাউকে মারতে পারে? নিহত সোহাগের মেয়ে সোহানা বলেন, আমরা এখন কোথায় যাবো? কার কাছে যাবো? আমার বাবার কী এমন অপরাধ ছিল তাকে এমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো? আমাদের কী দোষ ছিল যে আমাদের এইভাবে এতিম করা হলো?
রবিনের দায় স্বীকার আদালতে: ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যা ঘটনায় ছাত্রদলের বহিষ্কৃত নেতা রবিন আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। গতকাল বিকালে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হাসিব উল্লাহ গিয়াসের আদালতে স্বেচ্ছায় এ জবানবন্দি দিয়েছে সে। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। আসামি রবিন রাজধানীর চকবাজার থানার ৩০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক। এর আগে বৃহস্পতিবার রবিনের দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল রানা। রিমান্ড শেষে আদালতে হাজির করা হলে স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দেয় রবিন। সোহাগ হত্যার ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় দু’টি মামলা হয়। একটি হত্যা অন্যটি অস্ত্র মামলা। এরমধ্যে হত্যা মামলায় মাহমুদুল হাসান মহিনকে পাঁচদিন এবং তারেক রহমান রবিনকে অস্ত্র মামলায় দু’দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।
টিটন পাঁচদিনের রিমান্ডে: সোহাগকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার মো. টিটন গাজীর পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল বিকালে শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হাসিব উল্লাহ গিয়াসের আদালত এই আদেশ দেন। এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার পুলিশ পরিদর্শক মো. নাসির উদ্দিন আসামিকে আদালতে হাজির করে সাতদিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। এদিন আসামির পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। টিটনের রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, আসামি টিটন গাজী ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। সে ঘটনায় জড়িত অন্যান্য আসামির পরিচিত। এজাহারনামীয় অন্যান্য আসামির পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা সংগ্রহসহ এজাহারে অজ্ঞাতনামা আসামিদের শনাক্তে তাকে রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। আসামিকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে মামলার ঘটনার ধারাবাহিকতা, পরিকল্পনা, প্রস্তুতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব হবে এবং ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র-সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা সম্ভব হবে। এদিকে, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছে আসামি টিটন। শুনানিতে বিচারক আসামি টিটন গাজীকে জিজ্ঞাসা করেন আপনি কিছু বলতে চান কিনা? জবাবে তিনি বলেন- জি স্যার, আমার কোনো আইনজীবী নেই। আপনি (বিচারক) যে ভাইরাল হওয়া ভিডিও দেখেছেন, সেখানে আমাকে দেখা যাচ্ছে। আমি কাউকে আঘাত করিনি। আমাকে মোবাইলে ফোন করে ডাকা হয়েছিল। ফোন পেয়ে সেখানে যাই। আমি কাউকে আঘাত করিনি। ভিকটিমকে আঘাত করার জন্য হুকুমও দেইনি। আমি শুধু দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি নির্দোষ স্যার। বিচারক শুনানি শেষে আসামির পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
চাঁদাবাজি নয় ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে খুন-ডিএমপি: গতকাল ডিএমপি’র মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা জানিয়েছে ভাঙাড়ি ব্যবসা এবং দোকানে কারা ব্যবসা করবে সেটা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। হত্যাকাণ্ডের শিকার সোহাগ এবং যারা হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে তারা একসঙ্গে কিছুদিন ব্যবসা করেছে। যখন ব্যবসা লেনদেন নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় তখনই তারা বিবাদে লিপ্ত হয়। এর ফলে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। এ ঘটনায় পুলিশ অত্যন্ত তৎপর রয়েছে। এই চাঞ্চল্যকর ঘটনায় মূল রহস্য উদ্ঘাটন, সংশ্লিষ্ট সব অপরাধী গ্রেপ্তার এবং সোহাগ কেন এই ঘটনার শিকার হলো তা উদ্ঘাটনের জন্য একটি চৌকস টিম গঠন করা হয়েছে। ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি। র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) একেএম শহিদুর রহমান বলেন, ঘটনাটি স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে ঘটেছে। তবে এটার বিস্তারিত বলার মতো অবস্থায় আমরা নেই। আপাতত আমরা এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্তদের গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনা করে যাচ্ছি
Add Comment