ঈমান ও আকিদা
ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ স্বীকার করা, স্বীকৃতি দেওয়া, মতান্তরে দৃঢ় বিশ্বাস করা। ইসলাম ধর্মে ঈমানের অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। মানুষের প্রকৃতি ও মানবজাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, সঠিক বিশ্বাসই মানুষের সকল সফলতা ও সৌভাগ্যের ভিত্তি। বিশ্বাসই মানুষের পরিচালিকা শক্তি। সঠিক বিশ্বাস মানুষকে মানবতার শিখরে তুলে দেয় এবং তার জীবনে বয়ে আনে অফুরন্ত শান্তি ও আনন্দ। আমরা জানি, বিশ্বাস ও কর্মের সমন্বয়ে ইসলাম। সঠিক বিশ্বাস বা ঈমানই ইসলামের মূল ভিত্তি। আমরা যত ইবাদত ও সৎকর্ম করি সবকিছু আল্লাহর নিকট কবুল বা গ্রহণযোগ্য হওয়ার শর্ত ঈমান। ঈমানের ৭ (সাত) টি স্তম্ভ হচ্ছে। ঈমান অর্থ নিশ্চিন্ত বিশ্বাস, যা ভীতি ও সন্দেহের বিপরীত’। সন্তান যেমন পিতা-মাতার কোলে নিশ্চিন্ত হয়, মুমিন তেমনি আল্লাহর উপরে ভরসা করে নিশ্চিন্ত হয়।
এক. একক ইলাহ হিসেবে আল্লাহকে বিশ্বাস করা।
দুই. আল্লাহর ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস করা।
তিন. সমস্ত আসমানী কিতাব সমূহতে বিশ্বাস।
চার. সকল নবী ও রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস।
পাঁচ.তাক্বদীর বা ভালো মন্দের ওপর আল্লাহর ক্ষমতা রয়েছে বলে বিশ্বাস করা।
ছয়. আখিরাত বা পরকালের প্রতি বিশ্বাস।
সাত. মৃত্যুর পর পুনঃজীবিত হওয়ার প্রতি বিশ্বাস।
আল-কোরআনের সূরা-বাকারা এর দুই হতে চার আয়াতে ঈমান সম্পর্কে এই বিষয় গুলি উল্লেখ করা হয়েছে।ঈমানের পারিভাষিক অর্থঃ
‘হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়নের নাম হ’ল ঈমান। যা আনুগত্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং গোনাহে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। ঈমান হ’ল মূল এবং আমল হ’ল শাখা’।
আল-কোরআনের সূরা-বাকারা এর দুই হতে চার আয়াতে ঈমান সম্পর্কে এই বিষয় গুলি উল্লেখ করা হয়েছে।
ঈমান হচ্ছে স্বীকারোক্তি এবং আমলের নাম। অর্থাৎ অন্তর ও জবানের স্বীকারোক্তি এবং অন্তর, জবান ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কর্মকে ঈমান বলা হয়। আনুগত্যের মাধ্যমে ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং পাপ কাজের মাধ্যমে তা কমে যায়। ঈমানের মধ্যে মু’মিনগণ পরস্পর সমান নয়; বরং তাদের একজন অপরজনের চেয়ে কম বা বেশী মর্যাদার অধিকারী। স্বীকারোক্তি এবং আমল- এ দু’টির সমষ্টির নাম ঈমান।
ঈমান পূর্ণ হওয়ার ৭ শর্ত
আবু আবদুর রহমান আবদুল্লাহ ইবনে ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বিষয়ের ওপর : এই সাক্ষ্য দেওয়া, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর বান্দা ও রাসুল, নামাজ কায়েম করা, জাকাত প্রদান করা, বাইতুল্লাহর হজ করা, রমজান মাসে রোজা রাখা।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৭৪০৩) আলোচ্য হাদিসে ইসলামের পাঁচটি মৌলিক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, যা অস্বীকার করলে ব্যক্তি মুসলিম থাকবে না। এর প্রথমটি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের সাক্ষ্য দেওয়া। আর ঈমানের সাক্ষ্য গ্রহণে বিশেষজ্ঞ আলেমরা কতগুলো শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন, যা পূরণ করা ছাড়া ব্যক্তির ‘মুমিন’ হওয়ার দাবি যথার্থ বিবেচিত হবে না। আবদুর রহমান ইবনে হাসান (রহ.) ‘ফাতহুল মাজিদ শরহু কিতাবুত তাওহিদ’ বইয়ে (১/১৫৪) বলেন, ঈমানের সাক্ষ্য কবুল হওয়ার জন্য সাতটি শর্ত বা দাবি রয়েছে। শর্তগুলো পূরণ করা ছাড়া তা সাক্ষ্যদানকারীর কোনো উপকারে আসবে না। তা হলো :
১. শিরকের বিপরীত ইখলাস : ঈমানের প্রথম ও প্রধান দাবি হলো, আল্লাহর নাম ও গুণাবলিতে কাউকে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য শরিক করা থেকে বিরত থাকা এবং একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর ইবাদত করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘জেনে রেখো! অবিমিশ্র আনুগত্য শুধু আল্লাহরই প্রাপ্য।’ (সুরা : জুমার, আয়াত : ৩) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমার সাফায়াত লাভের ব্যাপারে কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে সৌভাগ্যবান হবে, যে তার অন্তর থেকে একনিষ্ঠভাবে বলে আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৯৯)
২. সন্দেহের বিপরীত দৃঢ় বিশ্বাস : আল্লাহর নাম, গুণাবলি, ক্ষমতা ও রাজত্বের ব্যাপারে সংশয় ও সন্দেহ ছাড়া বিশ্বাস স্থাপন করা। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ওপর ঈমান আনে এবং পরে সন্দেহ পোষণ করে না। (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ১৫)
৩. ছেড়ে দেওয়ার বিপরীতে ধারাবাহিকতা : ঈমানের অন্যতম দাবি হলো তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং সৎকর্মপরায়ণ হয় সে তো দৃঢ়ভাবে ধারণ করে এক মজবুত হাতল। (সুরা : লুকমান, আয়াত : ২২)
৪. অজ্ঞতার বিপরীত জ্ঞান : আল্লাহর প্রতি মুমিনের ঈমান অজ্ঞতাসুলভ হবে না; বরং সে আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলির জ্ঞান অর্জন করবে। আল্লাহ বলেন, ‘…যারা সত্য উপলব্ধি করে তার সাক্ষ্য দেয়, তারা ছাড়া।’ (সুরা : জুখরুফ, আয়াত : ৮৬)
উসমান ইবনে আফফান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি এই অবস্থায় মারা গেল যে সে জানে ‘আল্লাহ ছাড়া কেউ উপাস্য নেই’ সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৪৫)
৫. প্রত্যাখ্যানের বিপরীতে আঁকড়ে ধরা : আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘…সেদিন তারা আত্মসমর্পণ করবে। তারা পরস্পর মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তারা বলবে, নিশ্চয়ই তোমরা তোমাদের শক্তি নিয়ে আমাদের কাছে আসতে। তারা বলবে, তোমরা তো বিশ্বাসীই ছিলে না এবং তোমাদের ওপর আমাদের কোনো কর্তৃত্ব ছিল না; বরং তোমরাই ছিলে সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়। আমাদের ব্যাপারে আমাদের প্রতিপালকের কথা সত্য হয়েছে, অবশ্যই আমাদের শাস্তি ভোগ করতে হবে। আমরা তোমাদের বিভ্রান্ত করেছিলাম, কারণ আমরা নিজেরাও বিভ্রান্ত ছিলাম। তারা সবাই সেদিন শাস্তির অংশীদার হবে। অপরাধীদের প্রতি আমি এরূপই করে থাকি। তাদের ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য মাবুদ নেই’ বলা হলে তারা অহংকার করত।’ (সুরা : সাফফাত, আয়াত : ২৭-৩৫)
৬. মিথ্যার বিপরীতে সত্য : আল্লাহ কখনো কখনো পরীক্ষার মাধ্যমে ঈমানের দাবিতে মুমিন সত্যবাদী কি না তার পরীক্ষা নেবেন। ইরশাদ হয়েছে, “মানুষ কি মনে করে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এ কথা বললেই তাদের পরীক্ষা না করে ছেড়ে দেওয়া হবে। আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদেরও পরীক্ষা করেছিলাম; আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দেবেন কারা সত্যবাদী এবং তিনি অবশ্যই প্রকাশ করে দেবেন কারা মিথ্যাবাদী।” (সুরা : আনকাবুত, আয়াত : ২-৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার অন্তর থেকে সত্য জেনে এই সাক্ষ্য দেবে, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল’, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেবেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১২৭)
৭. আল্লাহর জন্য সম্পর্ক, আল্লাহর জন্য বিচ্ছেদ: আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আপনি আল্লাহ ও শেষ দিবসের ওপর বিশ্বাসী কোনো সম্প্রদায়কে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি বিরুদ্ধাচরণকারীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারেন না; যদিও তারা (বিরোধীরা) তাদের পিতা, পুত্র, ভাই ও সগোত্রীয় লোক হয়।’ (সুরা : মুজাদালাহ, আয়াত : ২২)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিনটি বৈশিষ্ট্য থাকলে ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ পাবে : তার কাছে সব কিছুর চেয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সবচেয়ে বেশি প্রিয় হলে, সে কাউকে শুধু আল্লাহর জন্য ভালোবাসলে, সে আগুনে পড়াকে যেমন অপছন্দ করে, কুফরির দিকে ফিরে যেতে এমন অপছন্দ করলে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৯৪১)
কালিমা : আরবি, উচ্চারণ ও অর্থসহ ৪ কালিমা
নবী করীম (সা:)এরশাদ করেছেন: ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির উপর স্থাপিত : কালিমা-নামায-রোজা-হজ্ব-যাকাত (বুখারী ও মুসলিম) উক্ত হাদীসে রাসূলে আকরাম (সা:) ইসলাম ধর্মের বুনিয়াদ অর্থাৎ ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি প্রস্তর হিসাবে পাঁচটি জিনিসকে ঘোষনা করেছেন। তন্মধ্যে প্রথম এবং প্রধান হল কালিমা।কালেমা ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস সম্বলিত কয়েকটি আরবি পংক্তির নাম। এর মাধ্যমেই ইসলামের প্রথম স্তম্ভ পূর্ণতা পায়। ইসলামে কালমিার গুরুত্ব ও মর্যাদা অনেক । কালিমার মূল অবকাঠামো হচ্ছে বিশ্বাস। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : “যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মারা যায় যে সে জানে আল্লাহ ছাড়া কোন সঠিক উপাস্য নেই সে জান্নাতে যাবে।
এক. কালিমা তাইয়্যেবা
আরবী :
لآ اِلَهَ اِلّا اللّهُ مُحَمَّدٌ رَسُوُل اللّهِ
বাংলা উচ্চারণ : লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।
বাংলা অর্থ : আল্লাহ এক আর কোন মাবুদ নেই। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।
দুই. কালিমা শাহাদৎ
আরবী :
اشْهَدُ انْ لّآ اِلهَ اِلَّا اللّهُ وَحْدَه لَا شَرِيْكَ لَه، وَ اَشْهَدُ اَنَّ مُحَمَّدً اعَبْدُهوَرَسُولُه
বাংলা উচ্চারণ : আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা শারীকালাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু। বাংলা অর্থ : আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন মাবুদ নেই। তিনি এক। তাঁহার কোন অংশীদার নেই, এবং আমি আরও সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, নিশ্চয়ই হযরত মুহাম্মদ (সঃ) আল্লাহ্র প্রেরিত বান্দা ও রাসূল।
তিন. কালিমা তামজীদ
আরবী :
لاَ اِلَهَ اِلاَّ اَنْتَ وَاحِدَ لاَّثَانِىَ لَكَ مُحَمَّدُرَّ سُوْلُ اللهِ اِمَامُ الْمُتَّقِيْنَ رَسُوْ لُرَبِّ الْعَلَمِيْنَ
উচ্চারণ : লা-ইলাহা ইল্লা আনতা ওয়াহেদাল্লা ছানীয়ালাকা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ইমামুল মুত্তাকীনা রাছূলু রাব্বীল আলামীন ।
অনুবাদ : আল্লাহ ব্যতীত আর কেহ এবাদাতের যোগ্য নয়। তিনি এক তাঁহার অংশীদার নাই, মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ (সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুত্তাকীনদের (ধর্মভীরু গণের) ইমাম এবং বিশ্ব পালকের প্রেরিত পুরুষ ।
চার. কালিমা তাওহীদ
আরবী :
لاَ اِلَهَ اِلاَّ اَنْتَ نُوْرَ يَّهْدِىَ اللهُ لِنُوْرِهِ مَنْ يَّشَاءُ مُحَمَّدُ رَّسَوْ لُ اللهِ اِمَامُ الْمُرْسَلِيْنَ خَا تَمُ النَّبِيِّنَ
উচ্চারন ঃ লা-ইলাহা ইল্লা আনতা নুরাইইয়াহ দিয়াল্লাহু লিনুরিহী মাইয়্যাশাউ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহি ইমামুল মুরছালীনা খাতামুন-নাবিয়্যীন ।
অনুবাদ ঃ হে খোদা! তুমি ব্যতীত কেহ উপাসনার উপযুক্ত নাই, তুমি জ্যোতিময়। তুমি যাহাকে ইচ্ছে করো আপন জ্যোতি প্রদর্শন কর। মুহাম্মদ (সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রেরিত রাসূলগণের ইমাম এবং শেষ নবী।
বাংলা অর্থ : হে আল্লাহ্! আমি তমার নিকট আকাঙ্ক্ষা করছি যে আমি যেন কাউকে তমার সাথে শরিক না করি। আমি আমার জ্ঞাত ও অজ্ঞাত পাপ হতে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তা হতে তোবা করছি। কুফরী, শিরক ও অন্যান্য সব পাপ হতে দূরে থাকছি। এবং স্বীকার করছি যে, “আল্লাহ এক আর কোন মাবুদ নেই। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।”
Add Comment