সংকলনে : এডভোকেট ড. মো: জিয়াউর রহমান; সাওম বা রোজা সম্পকৃত বিস্তারিত আলোচনা
ফারসি শব্দ রোজার আরবি অর্থ হচ্ছে সওম, বহুবচনে সিয়াম। সওম বা সিয়ামের বাংলা অর্থ বিরত থাকা। ইসলামী শরীয়তে সওম হল আল্লাহর নির্দেশ পালনের উদ্দেশে নিয়তসহ সুবহে সাদিকের শুরু থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও ন্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা। দ্বিতীয় হিজরীর শাবান মাসে মদীনায় রোজা ফরজ সংক্রান্ত আয়াত নাজিল হয় “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো যেভাবে তা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা সংযমী হও”। (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৩)। রোজা শুধু আল্লাহর জন্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজের সঙ্গে রোজার সম্পর্ক ঘোষণা করেছেন। এমনিভাবে তিনি সব ইবাদত-বন্দেগি থেকে রোজাকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছেন। যেমন তিনি এক হাদিসে কুদসিতে বলেন, ‘মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য, কিন্তু রোজা এর ব্যতিক্রম, তা শুধু আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান দেব।'(মুসলিম -২৭৬০) এ হাদিস দ্বারা আমরা অনুধাবন করতে পারি, নেক আমলের মাঝে রোজা রাখার গুরুত্ব আল্লাহর কাছে কত বেশি। তাই সাহাবি আবু হুরাইরা (রা.) যখন বলেছিলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাকে অতি উত্তম কোনো নেক আমলের নির্দেশ দিন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তুমি রোজা রাখো। কারণ এর সমমর্যাদার আর কোনো আমল নেই। ‘ (নাসায়ি-২৫৩৪)
রোজা রাখার নিয়ত :
نويت ان اصوم غدا من شهر رمضان المبارك فرضا لك ياالله فتقبل منى انك انت السميع العليم
উচ্চারণ- নাওয়াইতু আন আছুমা গাদাম মিন শাহরি রমাদ্বানাল মুবারকি ফারদ্বল্লাকা ইয়া আল্লাহু ফাতাক্বব্বাল মিন্নী ইন্নাকা আনতাস সামীউল আলীম।
অর্থ-হে আল্লাহ! আগামীকাল পবিত্র রমযান মাসে তোমার পক্ষ হতে ফরজ করা রোজা রাখার নিয়ত করলাম, অতএব তুমি আমার পক্ষ হতে তা কবুল কর। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী।
রোজার বাংলা নিয়ত ঃ
হে আল্লাহ পাক! আপনার সন্তুষ্টির জন্য আগামীকালের রমাদ্বান শরীফের ফরজ রোযা রাখার নিয়ত করছি। আমার তরফ থেকে আপনি তা কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাত।
ইফতারের দোয়া :
اللهم لك صمت و على رزقك افطرتاللهم لك صمت و على رزقك افطرت
উচ্চারণ ঃ আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া তাওয়াক্কালতু আ’লা রিজক্বিকা ওয়া আফতারতু বি রাহমাতিকা ইয়া র্আ হামার রা-হিমীন।
অর্থ-হে আল্লাহ! আমি তোমারই সন্তুষ্টির জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমারই দেয়া রিযিক্ব দ্বারা ইফতার করছি।
ইফতারের বাংলা দোয়া-
হে আল্লাহ তায়ালা আমি আপনার নির্দেশিত মাহে রমজানের ফরজ রোজা শেষে আপনারই নির্দেশিত আইন মেনেই রোজার পরিসমাপ্তি করছি ও রহমতের আশা নিয়ে ইফতার আরম্ভ করছি। তারপর “বিসমিল্লাহি ওয়া’আলা বারাকাতিল্লাহ” বলে ইফতার করা।
তারাবিহ পড়ার নিয়ম
দুই রাকাআত নামাজ আদায় করে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করা। আবার দুই রাকাআত নামাজ পড়া। এভাবে ৪ রাকাআত আদায় করার পর একটু বিশ্রাম নেয়া। বিশ্রামের সময় তাসবিহ তাহলিল পড়া, দোয়া-দরূদ ও জিকির আজকার করা। তারপর আবার দুই দুই রাকাআত করে আলাদা আলাদা নিয়তে তারাবিহ আদায় করা।
তারাবিহ নামাজের দোয়া
৪ রাকাআত তারাবিহ আদায় করার পর ব্যাপক প্রচলিত একটি দোয়া রয়েছে। যা দেশের প্রায় মসজিদে পড়া হয়। আর তাহলো-
سُبْحانَ ذِي الْمُلْكِ وَالْمَلَكُوتِ سُبْحانَ ذِي الْعِزَّةِ وَالْعَظْمَةِ وَالْهَيْبَةِ وَالْقُدْرَةِ وَالْكِبْرِيَاءِ وَالْجَبَرُوْتِ سُبْحَانَ الْمَلِكِ الْحَيِّ الَّذِيْ لَا يَنَامُ وَلَا يَمُوْتُ اَبَدًا اَبَدَ سُبُّوْحٌ قُدُّوْسٌ رَبُّنا وَرَبُّ المْلائِكَةِ وَالرُّوْحِ
উচ্চারণ : ‘সুবহানা জিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি, সুবহানা জিল ইয্যাতি ওয়াল আঝমাতি ওয়াল হায়বাতি ওয়াল কুদরাতি ওয়াল কিব্রিয়ায়ি ওয়াল ঝাবারুতি। সুবহানাল মালিকিল হাইয়্যিল্লাজি লা ইয়ানামু ওয়া লা ইয়ামুত আবাদান আবাদ; সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রাব্বুনা ওয়া রাব্বুল মালায়িকাতি ওয়ার রূহ।’ উল্লেখ্য তারাবিহ নামাজের ৪ রাকাআত পর পর পড়ার এ দোয়াটি ব্যাপক প্রচলিত। তবে এ দোয়ার সঙ্গে তারাবিহ নামাজ হওয়া কিংবা না হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। এমন নয় যে, এ দোয়া না জানলে তারাবিহ নামাজ আদায় হবে না। বরং যে কোনো দোয়াই পড়া যাবে। তবে এ সময়টিতে কুরআন-সুন্নাহর দোয়াগুলো পড়াই উত্তম।
তারাবিহ নামাজের মুনাজাত
অনেকেই ৪ রাকাআত পর পর মুনাজাত করে থাকে। আবার অনেকে পুরো নামাজ শেষ করে মুনাজাত করে থাকে। তবে নামাজ শেষ করে বিতর পড়ে মুনাজাত দেয়াই উত্তম। মুনাজাতের ক্ষেত্রেও একটি দোয়া ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে।এ মুনাজাতটিকেও অনেকে আবশ্যক মনে করে। কেউ কেউ এমনও মনে করে যে, এ দোয়াটি ছাড়া তারাবিহ নামাজের মুনাজাত হবে না।এটি মোটেও ঠিক নয়। তবে এ দোয়ায় মুনাজাত দিলে গোনাহ হবে তা নয়। মুনাজাতটি হলো-
اَللَهُمَّ اِنَّا نَسْئَالُكَ الْجَنَّةَ وَ نَعُوْذُبِكَ مِنَ النَّارِ يَا خَالِقَ الْجَنَّةَ وَالنَّارِ- بِرَحْمَتِكَ يَاعَزِيْزُ يَا غَفَّارُ يَا كَرِيْمُ يَا سَتَّارُ يَا رَحِيْمُ يَاجَبَّارُ يَاخَالِقُ يَابَارُّ – اَللَّهُمَّ اَجِرْنَا مِنَ النَّارِ يَا مُجِيْرُ يَا مُجِيْرُ يَا مُجِيْرُ- بِرَحْمَتِكَ يَا اَرْحَمَ الرَّحِمِيْنَ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকাল জান্নাতা ওয়া নাউজুবিকা মিনাননার। ইয়া খালিক্বাল জান্নাতি ওয়ান নার। বিরাহমাতিকা ইয়া আঝিঝু ইয়া গাফফার, ইয়া কারিমু ইয়া সাত্তার, ইয়া রাহিমু ইয়া ঝাব্বার, ইয়া খালিকু ইয়া বার্রু। আল্লাহুম্মা আঝিরনা মিনান নার। ইয়া মুঝিরু, ইয়া মুঝিরু, ইয়া মুঝির। বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমিন।’
উল্লেখ্য, রমজান জুড়ে বিশ্বনবির এ দোয়াগুলো বেশি বেশি করা জরুরি। আর তাহলো-
– اَﻟﻠَّﻬُﻢَّ ﺇﻧَّﻚَ ﻋَﻔُﻮٌّ ﺗُﺤِﺐُّ اﻟْﻌَﻔْﻮَ ﻓَﺎﻋْﻒُ ﻋَﻨِّﻲ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুওউন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’ফু আ’ন্নি।
তাছাড়া তারাবিহ নামাজের পর সাইয়্যিদুল ইসতেগফারও পড়া যেতে পারে-
– اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বি লা ইলাহা ইল্লা আনতা খালাক্বতানি; ওয়া আনা আ’বদুকা ওয়া আনা আ’লা আ’হদিকা ওয়া ওয়া’দিকা মাসতাত্বা’তু, আউজুবিকা মিন শাররি মা সানা’তু আবুউলাকা বিনি’মাতিকা আলাইয়া; ওয়া আবুউ বিজামবি ফাগফিরলি ফা ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ জুনুবা ইল্লা আনতা।’
মুসলিম উম্মাহর জন্য এক মহাঅনুগ্রহের মাস রমজান। এ মাসের মর্যাদা অন্য মাসের তুলনায় অনেক বেশি। এ মাসের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত হলো কিয়ামুর রমজান তথা তারাবিহ নামাজ। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যথাযথভাবে তারাবিহ নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন। রাতের নামাজ (তারাবিহ) আদায়েল মাধ্যমে বিগত জীবনের সব গোনাহ থেকে মুক্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন।
রোজার নিয়ত সংকান্ত কতিপয় মাসয়ালা :
অন্তরের দৃঢ় সংকল্পকে নিয়ত বলা হয়। মুখে বলা জরুরি নয়। এ সম্পর্কে আল্লামা শামি (রহ.) লিখেছেন, ‘আভিধানিক সূত্রে নিয়ত হলো ‘আজম’ আর আজম বলা হয়- মনের দৃঢ় সংকল্পকে। ’ -ফাতাওয়ায়ে শামি : ২/৯০
নিয়ত রোজার রোকন তথা শর্ত। আর ইবাদতের সওয়াবও নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। হাদিস শরিফে আছে, ‘সকল আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। ’ -সহিহ বোখারি
নিয়তের ক্ষেত্রে সাধারণত আমরা দুই ধরনের ভুলের শিকার হয়ে থাকি। যেমন-
১. কেউ কেউ নিয়তের শব্দগুলো শুধু মুখে উচ্চারণ করেন; অন্তরে সংকল্প করেন না।
২. আবার অনেকে নিয়তের শব্দগুলো মুখেও উচ্চারণ করেন না; অন্তরেও কোনো কল্পনা উপস্থিত করেন না। তার মানে নিয়ত ফরজ হওয়ার কথা তিনি জানেনই না।
উপরোক্ত দুই শ্রেণির কারো রোজাই হবে না। এ সম্পর্কে আদ্দুররুল মুখতার প্রণেতার ভাষ্য হলো- ‘নিয়তের ক্ষেত্রে অন্তরের সুদৃঢ় কর্মতৎপরতা গ্রহণযোগ্য। কাজেই শুধু মুখের উচ্চারণ কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, যদি তা অন্তরের কথার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়। কেননা, শুধু মুখের উচ্চারণকে কথা বলা হয়; নিয়ত বলা হয় না। ’ -আদ-দুররুল মুখতার: ২/৯১
নির্ভরযোগ্য ফিকহি উদ্ধৃতিসহ নিয়ত সংক্রান্ত কিছু মাসয়ালা হলো-
মাসয়ালা ঃ ফরজ রোজার নিয়ত রাত বাকি থাকতেই করা উত্তম। উম্মুল মুমিনিন হজরত হাফসা (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ফজরের আগে রোজা রাখার নিয়ত করবে না তার রোজা (পূর্ণাঙ্গ) হবে না। ’ -সুনানে আবু দাউদ: ১/৩৩৩
এই হাদিসকে ভিত্তি ধরে ইসলামি স্কলাররা বলেন, দিনের দ্বিপ্রহরের আগে রোজার নিয়ত করা না হয়ে থাকলে সেই রোজা সহিহ হবে না। এর পরও রোজাহীন অবস্থায় দিনের বাকি সময়ে পানাহার করা রমজানুল মোবারকের সম্মানের বিরোধী বলে তা জায়েজ নয়। -সূত্র : ইমদাদুল ফাতাওয়া: ১/১৭৩
নফল রোজা, নির্দিষ্ট মানতের রোজা এবং রমজানের রোজাসমূহের নিয়ত রাতের বেলা অথবা শরিয়তের ঘোষিত দ্বিপ্রহরের আগ পর্যন্ত করা গেলেও অন্য সব ধরনের রোজার জন্য রাতেই নিয়ত করে নেওয়া জরুরি। -ফাতাওয়া দারুল উলুম: ৬/৩৪৬
মাসয়ালা ঃ মনে মনে নিয়ত করাই যথেষ্ট। তবে ‘নাওয়াইতু বি সাউমি গাদিম মিন শাহরি রামাজান’ মুখে উচ্চারণ করার মাধ্যমে নিয়ত করা উত্তম। -বেহেশতি জেওর: ৩/৩
অথবা এরূপ করবে, ‘নাওয়াইতুআন আসুমা গাদাম মিন শাহরি রামাজান। ’ অর্থাৎ ‘রমজান মাসের আগামীকালের রোজা রাখার নিয়ত করছি। ’ এক কথায়, আরবিতে হোক বা বাংলায় হোক কিংবা নিজ নিজ ভাষায় হোক- আমি রোজা রাখছি এটা স্পষ্ট করতে হবে, এটাই রোজার নিয়ত।
মাসয়ালা ঃ রমজানের প্রতিদিনই রোজার নিয়ত করতে হবে। একদিন নিয়ত করলে পুরো রমজানের জন্য তা যথেষ্ট নয়। -ইলমুল ফিকাহ: ৩/১৮
কারণ প্রতিটি রোজা ভিন্ন ভিন্ন আমল (ইবাদত)। আর প্রতিটি আমলের জন্যই নিয়ত করা জরুরি। রাতের বেলায় মনে মনে রোজা রাখার ইচ্ছা নিয়ে শুয়ে পড়লে তার জন্য পুনারয় নিয়ত করার প্রয়োজন নেই।
মাসয়ালা ঃ রাতে (সেহরির সময় থাকা অবস্থায়) রোজার নিয়ত করলেও সুবহে সাদেক পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী-মিলনের অবকাশ থাকে। এতে নিয়তের কোনো ক্ষতি হবে না। অনেকে রাতের শুরুতে বা মাঝামাঝি সময়ে সেহরি খেয়ে শুয়ে পড়েন এবং মনে করেন, রোজার নিয়ত করার পর বা সেহরি খেয়ে ফেলার পর আর কিছু পানাহার করা যাবে না। এমন ধারণা ঠিক নয়। সুবহে সাদেক স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত পানাহার করতে কোনো দোষ নেই। তা নিয়ত করা হোক বা না হোক। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে রমজানের রাতে স্বীয় স্ত্রীর সঙ্গে প্রবৃত্ত হওয়া। ’ -সূরা বাকারা : ১৮৭
মাসয়ালা ঃ রমজান মাসে সেহরি খাওয়াটাও রোজার নিয়ত বলে গণ্য হবে। তবে সেহরি খাওয়ার সময় রোজা রাখার ইচ্ছা না থাকলে তা নিয়ত বলে গণ্য হবে না। -কিতাবুল ফিকাহ: ১/৮৮১
মাসয়ালা ঃ নিয়তের সময় শুরু হয় পূর্বের দিনের সূর্যাস্তের পর থেকে। যেমন- রোববারে রোজার নিয়ত শনিবার দিবাগত রাত তথা সূর্যাস্তের পর থেকে করা যায়। শনিবার সূর্যাস্তের পূর্বে রোববারের রোজার নিয়ত করা যথেষ্ট নয়। কেননা, হাদিস শরিফে রাতে নিয়ত করার কথা বলা হয়েছে। হাদিসে আছে, হজরত হাফসা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তার রোজা নেই, যে রাতে নিয়ত করেনি। ’ -মুসনাদে আহমাদ ও সুনানে আবু দাউদ
রোজার ফজিলত ও তাৎপর্য
রোজার এত মর্যাদার কারণ কী, তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ভালো জানেন। তবে আমরা যা দেখি তা হলো, রোজা এমন একটি আমল, যাতে লোকদেখানো ভাব থাকে না। এটি বান্দা ও আল্লাহর মধ্যকার একটি অতি গোপন বিষয়। নামাজ, হজ, জাকাতসহ অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি কে সম্পাদন করল তা দেখা যায়। পরিত্যাগ করলেও বোঝা যায়। কিন্তু রোজার ক্ষেত্রে লোকদেখানো বা শোনানোর সুযোগ থাকে না। ফলে রোজার মধ্যে ইখলাস, আন্তরিকতা বা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা নির্ভেজাল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘রোজাদার আমার জন্যই পানাহার ও সহবাস পরিহার করে। ‘ (মুসলিম-২৭৬৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানব সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের প্রতিদান ১০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, কিন্তু রোজার বিষয়টি ভিন্ন। কেননা, রোজা শুধু আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান দেব। ‘ (মুসলিম-১৫৫১)
রোজা জাহান্নাম থেকে বাঁচার ঢাল :
হাদিসে এসেছে, ‘রোজা হলো ঢাল ও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার মজবুত দুর্গ। ‘ (মুসনাদে আহমদ-৯২১৪)
বুখারি ও মুসলিমের হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য এক দিন রোজা রাখবে, আল্লাহ তার থেকে জাহান্নামকে এক খরিফ (৭০ বছরের) দূরত্বে সরিয়ে দেবেন। ‘ (মুসলিম-২৭৬৯)
রোজা হলো জান্নাত লাভের পথ :
হাদিসে এসেছে, আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে এমন একটি কাজের নির্দেশ দিন, যার দ্বারা আমি লাভবান হতে পারি। তিনি বললেন, ‘তুমি রোজা রাখো। কেননা, এর সমকক্ষ আর কোনো ইবাদত নেই। ‘ (নাসায়ি -২২২০) রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন, ‘জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে। যার নাম রাইয়ান। কিয়ামতের দিন রোজাদারগণই শুধু সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। তাদের ছাড়া অন্য কেউ সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। সেদিন ঘোষণা করা হবে, রোজাদারগণ কোথায়? তখন তারা দাঁড়িয়ে যাবে এবং সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। যখন তাদের প্রবেশ শেষ হবে, তখন দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। ফলে তারা ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। ‘ (বুখারি-১৭৯৭)
রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়েও উত্তম :
নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যার হাতে মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন, সে সত্তার শপথ, রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ তায়ালার কাছে মেশকের ঘ্রাণ থেকেও প্রিয়। ‘ (বুখারি-১৭৯০)
রোজা ইহকাল ও পরকালের সাফল্যের মাধ্যম :
যেমন হাদিসে এসেছে, ‘রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ : একটি হলো ইফতারের সময়, অন্যটি তার প্রতিপালকের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়। ‘ (মুসলিম-১১৫১)
রোজা কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে :
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘রোজা ও কোরআন কিয়ামতের দিন মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে রোজা বলবে, হে প্রতিপালক! আমি দিনের বেলা তাকে পানাহার ও সহবাস থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল করো। কোরআন বলবে, হে প্রতিপালক! আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি, তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল করো। তিনি বলেন, ‘এরপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে। ‘ (মুসনাদে আহমদ-৬৬২৬)
রোজা গুনাহ মাফের কারণ ও কাফফারা :
হাদিসে এসেছে, ‘মানুষ যখন পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী ও ধন-সম্পদের কারণে গুনাহ করে ফেলে, তখন নামাজ, রোজা, সদকা সে গুনাহগুলোকে মিটিয়ে দেয়। ‘ (বুখারি-১৭৯৫)
আর রমজান তো গুনাহ মাফ ও মিটিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আরো বেশি সুযোগ দিয়েছে। হাদিসে এসেছে, ‘যে রমজান মাসে ইমান ও ইহতিসাবের সঙ্গে রোজা রাখবে, তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। ‘ (বুখারি-২০১৪)
ইহতিসাব : ইহতেসাব হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার পাওয়া যাবে-এ দৃঢ় বিশ্বাস রেখে নিষ্ঠার সঙ্গে সন্তুষ্টচিত্তে রোজা ও অন্যান্য আমল করা।
রোজার হিকমত, লক্ষ্য ও উপকারিতা:
১. তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন। ২. শয়তান ও কুপ্রবৃত্তির ক্ষমতা দুর্বল করা। ৩. রোজা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ ও তাঁর দাসত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যম। ৪. ঈমানকে দৃঢ় করা, মোরাকাবা ও আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করার সুন্দর পন্থা। ৫. ধৈর্য, সবর ও দৃঢ় সংকল্প সৃষ্টির মাধ্যম। ৬. নিজেকে আখিরাতমুখী করার অনুশীলন। ৭. আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি শুকরিয়া ও সৃষ্ট জীবের সেবা করার দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়। ৮. জাগতিকভাবে শারীরিক শক্তি ও সুস্থতা অর্জনের উত্তম উপায়।
সেহরি খাওয়া :
রোজা রাখার জন্য সেহরি খাওয়া সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সেহরি খাও। কারণ সেহরিতে বরকত রয়েছে। ‘ (বুখারি-১৯২৩) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমাদের ও ইহুদি-খ্রিস্টানদের রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সেহরি খাওয়া। ‘ (মুসলিম-২৬০৪)
দেরি করে সেহরি খাওয়া :
সেহরির অর্থ হলো যা কিছু রাতের শেষভাগে খাওয়া হয়। সুন্নত হলো দেরি করে সেহরি খাওয়া। রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বদা শেষ সময়ে সেহরি খেতেন। ফজরের ওয়াক্ত আসার পূর্বক্ষণে সেহরি খেলে রোজা রাখতে অধিকতর সহজ হয়, ফজরের নামাজ আদায় করার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে কষ্ট করতে হয় না। সতর্কতা অবলম্বন করে ফজরের অনেক আগে সেহরি শেষ করা সুন্নত নয়। সেহরির সময় শেষ হলো কি না তা জানবেন নিজের চোখে পূর্বাকাশের শুভ্রতা দেখে, অথবা নির্ভরযোগ্য ক্যালেন্ডার ও নির্ভুল ঘড়ির মাধ্যমে সূক্ষ¥ ও সতর্ক হিসাব করে।
ইফতারে বিলম্ব না করা :
সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে রাতের আগমন ঘটে ও ইফতার করার সময় হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ যত দিন সময় হওয়া মাত্র ইফতার করবে, তত দিন কল্যাণের সঙ্গে থাকবে। ‘ (বুখারি-২৮৫২)
তিনি আরো বলেছেন, ‘যত দিন মানুষ সময় হওয়া মাত্র ইফতার করবে, তত দিন দ্বীন বিজয়ী থাকবে। কেননা, ইহুদি ও খ্রিস্টানরা ইফতারে দেরি করে। ‘ (আবু দাউদ-২৩৫৫)
সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা আরও বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সেই মাসকে পায় সে যেন রোজা রাখে”। পবিত্র রমজানের ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে হাদিসের কিতাবগুলোতে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এর ভেতর থেকে কিছু হাদিস এখানে উল্লেখ করা হলো-প্রিয় নবীজি (সা.) এর প্রিয় সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেছেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, যখন রমজান মাস আসে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। (বুখারী, মুসলিম) অপর হাদিসে এসেছে, হযরত সাহ্ল ইবনে সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (সা.) এরশাদ করেছেন, বেহেশতের ৮টি দরজা রয়েছে। এর মধ্যে ১টি দরজার নাম রাইয়ান। রোজাদার ব্যতিত আর কেউ ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারী, মুসলিম)
বিখ্যাত হাদিস বিশারদ সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, হুজুর (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসের রোজা রাখবে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমযান মাসের রাতে এবাদত করে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে কদরের রাতে ইবাদত করে কাটাবে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (বুখারী, মুসলিম)
হাদিসে আরো এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, রোজা ছাড়া আদম সন্তানের প্রত্যেকটি কাজই তার নিজের জন্য। তবে রোজা আমার জন্য। আমি নিজেই এর পুরস্কার দেব। রোজা (জাহান্নামের আজাব থেকে বাঁচার জন্য) ঢাল স্বরুপ। তোমাদের কেউ রোজা রেখে অশ্লীল কথাবার্তায় ও ঝগড়া বিবাদে যেন লিপ্ত না হয়। কেউ তার সঙ্গে গালমন্দ বা ঝগড়া বিবাদ করলে শুধু বলবে, আমি রোজাদার। সেই মহান সত্তার কসম যার করতলগত মুহাম্মদের জীবন, আল্লাহর কাছে রোজাদারের মুখের গন্ধ কস্তুরীর সুঘ্রানের চেয়েও উওম। রোজাদারের খুশির বিষয় ২টি-যখন সে ইফতার করে তখন একবার খুশির কারণ হয়। আর একবার যখন সে তার রবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রোজার বিনিময় লাভ করবে তখন খুশির কারণ হবে। (বুখারী)।
অপর একটি হাদিস হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, রাসুলে পাক (সা.) বলেছেন, রোজা এবং কোরআন (কেয়ামতের দিন) আল্লাহর কাছে বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে পরওয়ারদিগার! আমি তাকে (রমজানের) দিনে পানাহার ও প্রবৃত্তি থেকে বাধা দিয়েছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতের বেলায় নিদ্রা হতে বাধা দিয়েছি। সুতরাং আমার সুপারিশ তার ব্যাপারে কবুল করুন। অতএব, উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে (এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে)। (বায়হাকী)
হাদিস শরীফে আরো এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন রমজানের প্রথম রাত আসে শয়তান ও অবাধ্য জিনদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। অতপর এর কোনো দরজাই খোলা হয় না। বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। অতপর এর কোনো দরজাই বন্ধ করা হয় না। এ মাসে এক আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকে, হে ভালোর অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও। হে মন্দের অন্বেষণকারী! থামো। আল্লাহ তায়ালা এ মাসে বহু ব্যক্তিকে দোযখ থেকে মুক্তি দেন। আর এটা এ মাসের প্রতি রাতেই হয়ে থাকে। (তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ)।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, যখন রমজান মাস উপস্থিত হতো রাসুল (সা.) সমস্ত কয়েদিকে মুক্তি দিতেন এবং প্রত্যেক প্রার্থনাকারীকে দান করতেন। (বায়হাকী) হাদিসের বইয়ে আরো পাওয়া যায়, নবী করীম (সা.) বলেছেন, কেউ যদি (রোজা রেখেও) মিথ্যা কথা বলা ও খারাপ কাজ পরিত্যাগ না করে তবে তার শুধু পানাহার ত্যাগ করা (অর্থাৎ উপবাস ও তৃষ্ণার্ত থাকা) আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারী)
পবিত্র রমজান মাস মহান আল্লাহর সঙ্গে প্রিয় বান্দার প্রেম বিনিময়ের সবচেয়ে উত্তম সময়। এই মাসে পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে। তাই এ মাসের ফজিলত ও মর্যাদা বেড়ে গেছে আরো বহুগুণ। রমজানের ফজিলত নিয়ে আরো অনেক হাদিস বিভিন্ন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। হযরত সালমান ফারসী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, একবার রাসুল (সা.) আমাদের শাবান মাসের শেষ তারিখে ভাষণ দান করলেন এবং বললেন, হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের প্রতি ছায়া বিস্তার করেছে এক মহান মাস, মোবারক মাস। এটি এমন মাস যাতে একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তায়ালা এই মাসের রোজাগুলোকে করেছেন (তোমাদের ওপর) ফরজ আর রাতে নামাজ পড়াকে তোমাদের জন্য করেছেন নফল।
এই মাসে যে ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশে ১টি নফল আমল করল সে ওই ব্যক্তির সমান হলো, যে অন্য মাসে ১টি ফরজ আদায় করলো। আর যে ব্যক্তি এই মাসে ১টি ফরজ আদায় করলো সে ওই ব্যক্তির সমান হলো, যে অন্য মাসে ৭০টি ফরজ আদায় করলো। এটা ধৈর্যর মাস। আর র্ধৈয্যের সওয়াব হলো বেহেশত। এটা সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস। এটা সেই মাস যে মাসে মুমিন বান্দার রিজিক বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ মাসে যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তা তার জন্য গুনাহ মাফের এবং দোযখের আগুন থেকে মুক্তির কারণ হবে। এছাড়া তার ছওয়াব হবে রোজাদার ব্যক্তির সমান। অথচ রোজাদার ব্যক্তির সওয়াব কমবে না। এসব শুনে সাহাবীরা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তি তো এমন সামর্থ রাখেনা যে রোজাদারকে (তৃপ্তি সহকারে) ইফতার করাবে? রাসুল (সা.) বললেন, আল্লাহ পাক এই ছওয়াব দান করবেন যে রোজাদারকে ইফতার করায় এক চুমুক দুধ দিয়ে, অথবা একটি খেজুর দিয়ে, অথবা এক চুমুক পানি দিয়ে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়ায় আল্লাহ তায়ালা তাকে হাউজে কাউছার থেকে পানি পান করাবেন যার পর সে পুনরায় তৃষ্ণার্ত হবে না জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত।
এটা এমন পবিত্র মাসের প্রথম দিক রহমত, মাঝের দিক মাগফিরাত, আর শেষ দিক হচ্ছে দোযখ থেকে মুক্তির। যে ব্যক্তি এই মাসে আপন অধীনস্থ দাস-দাসীদের কাজের বোঝা হালকা করে দেবে মহান আল্লাহ তাকে মাফ করে দেবেন এবং তাকে দোযখ থেকে মুক্তি দান করবেন। (বায়হাকী) প্রিয় নবীর প্রিয় সাহাবী হযরত আবু ওবায়দা (রা.) রমজানের গুরুত্ব সম্পর্কে আরেকটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, হুজুর (সা.) এরশাদ করেছেন, রোজা মানুষের জন্য ঢালস্বরুপ যতক্ষণ পর্যন্ত তা ফেড়ে না ফেলা হয় (অর্থাৎ রোজা মানুষের জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হবে যতক্ষণ পর্যন্ত তা নিয়ম অনুযায়ী পালন করা হয়)। (ইবনে মাজাহ, নাসাঈ)
সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে এ সম্পর্কে আরেকটি বর্ণনা এসেছে। তিনি বলেছেন, হুজুর (সা.) এরশাদ করেছেন, অনেক রোজাদার ব্যক্তি এমন রয়েছে যাদের রোজার বিনিময়ে অনাহারে থাকা ব্যতিত আর কিছুই লাভ হয় না। আবার অনেক রাত জাগরণকারী এমন রয়েছে যাদের রাত জাগার কষ্ট ছাড়া আর কিছুই লাভ হয় না। (নেক আমল যদি এখলাস ও আন্তরিকতার সঙ্গে না হয়ে লোক দেখানোর উদ্দেশে হয় তাহলে এর বিনিময়ে কোনো সওয়াব পাওয়া যায় না)। (ইবনে মাজাহ, নাসাঈ)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) আরো বলেছেন, নবী করীম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে শরীয়ত সম্মত কোনো কারণ ছাড়া রমজানের একটি রোজাও ভাঙে সে রমজানের বাইরে সারাজীবন রোজা রাখলেও এর বদলা হবে না। (তিরমিযী, আবু দাউদ)
রমজানের ফজিলত সম্পর্কে বিখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, নবী করীম (সা.) বলেছেন, রমজানের জন্য বেহেশত সাজানো হয় বছরের প্রথম থেকে পরবর্তী বছর পর্যন্ত। তিনি বলেন, যখন রমজান মাসের প্রথম দিন উপস্থিত হয় বেহেশতের গাছের পাতা হতে আরশের নিচে বড় বড় চোখ বিশিষ্ট হুরদের প্রতি বিশেষ হাওয়া প্রবাহিত হয়। তখন তারা বলে, হে পালনকর্তা! আপনার বান্দাদের মধ্য হতে আমাদের জন্য এমন স্বামী নির্দিষ্ট করুন যাদের দেখে আমাদের চোখ জুড়াবে এবং আমাদের দেখে তাদের চোখ জুড়াবে।
রোজা সংক্রান্ত পবিত্র কোরআনের ৪টি আয়াত
১) হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্যে সিয়ামের বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। (সূরা বাকারা-২:১৮৩)
২) সিয়াম নির্দিষ্ট কয়েক দিনের। তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে অথবা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূর্ণ করবে। এটা যাদের সাতিশয় কষ্ট দেয় তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদইয়া-একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদান করা। যদি কেউ স্বা:স্ফূর্তভাবে সৎকাজ করে তবে তা তার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। আর সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্যে অধিকতর কল্যাণকর যদি তোমরা জানতে। (সূরা বাকারা-২:১৮৪)
৩) রমাজান মাস, এতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবর্তীর্ণ হয়েছে।সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে এবং কেউ অসুস্থ্য থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্যে যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্যে কষ্টকর তা চান না, এজন্যে যে তোমাদের সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদের সৎপথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মাহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে। (সূরা বাকারাহ ২:১৮৫)
৪) সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্যে তোমাদের স্ত্রীদের বৈধ করা হয়েছে। তারা তোমাদের জন্যে এবং তোমরাও তাদের জন্যে পরিচ্ছদ। আল্লাহ জেনেছেন যে, তোমরা তোমাদের নিজেদের সাথে খিয়ানত করছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদের তাওবা কবুল করেছেন এবং তোমাদেরকে মার্জনা করেছেন, সুতরাং এখন তোমরা তাদের সাথে সংগত হও এবং আল্লাহ তোমাদের জন্যে যা নির্ধারণ করে রেখেছেন (অর্থাৎ সন্তান) তা অন্বেষণ করো। আর তোমরা আহার করো ও পান করো যতক্ষণ তোমাদের জন্যে (রাত্রির) কালো রেখা থেকে ফজরের সাদা রেখা স্পষ্ট হয়ে যায়। এরপর রাত পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো। আর তোমরা মসজিদে ই’তিকাফ অবস্থায় তাদের সাথে সংগত হয়ো না। এগুলো আল্লাহর (নির্ধারিত) সীমা, সুতরাং এর নিকটবর্তী হয়ো না। এভাবেই আল্লাহ মানুষের জন্যে তার আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করতে পারে। (সূরা বাকারা ২:১৮৭)
রোজা সম্পর্কে ৫ হাদিস ঃ
১) হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ(সো:)ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবসহ রমজান মাসের সিয়াম পালন করবে, তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুণাহ মাফ করে দেওয়া হবে।(সহীহ বুখারী: ৩৮, সহীহ মুসলিম:৭৬০)
২) হযরত সাহল বিন সা’দ (রা.) হতে বর্ণিত।তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সো:) ইরশাদ করেন, জান্নাতের একটি দরজা আছে, একে রাইয়ান বলা হয়, এই দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন একমাত্র সায়িম ব্যক্তিই জান্নাত প্রবেশ করবে। তাদের ছাড়া অন্য কেউ এই পথে প্রবেশ করবে না। সেদিন এই বলে আহবান করা হবে সায়িমগণ কোথায়? তারা যেন এই পথে প্রবেশ করে। এভাবে সকল সায়িম ভেতরে প্রবেশ করার পর দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। অত:পর এ পথে আর কেউ প্রবেশ করেবে না। (সহীহ বুখারী:১৮৯৬, সহীহ মুসলিম: ১১৫২)
৩) হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ(সো:)ইরশাদ করেন, সিয়াম ঢালস্বরূপ। তোমাদের কেউ কোনোদিন সিয়াম পালন করলে তার মুখ থেকে যেন অশ্লীল কথা বের না হয়। কেউ যদি তাকে গালমন্দ করে অথবা ঝগড়ায় প্ররোচিত করতে চায় সে যেন বলে, আমি সায়িম। (সহীহ বুখারী: ১৮৯৪, সহীহ মুসলিম:১১৫১)
৪) হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ(সো:)ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, সিয়াম ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য, কিন্তু সিয়াম আমার জন্য এবং আমিই এর প্রতিদান দেব। সিয়াম ঢালস্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন সিয়াম পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি সায়িম (রোজাদার)। যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, তার শপথ! অবশ্যই সায়িমের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিসকের গন্ধের চেয়েও সুগন্ধি। সায়িমের জন্য রয়েছে দু’টি খুশি, যা তাকে খুশি করে। যখন যে ইফতার করে, সে খুশি হয় এবং যখন সে তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন সাওমের বিনিময়ে আনন্দিত হবে। (সহীহ বুখারী: ১৯০৪, সহীহ মুসলিম:১১৫১)
৫) হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ(সো:)ইরশাদ করেন, তোমাদের নিকট রমজান মাস উপস্থিত। এটা এক অত্যন্ত বারাকতময় মাস। আল্লাহ তা’য়ালা এ মাসে তোমাদের প্রতি সাওম ফরজ করেছেন। এ মাসে আকাশের দরজাসমূহ উন্মুক্ত হয়ে যায়, এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং এ মাসে বড় বড় শাইতানগুলোকে আটক রাখা হয়।আল্লাহর জন্যে এ মাসে একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও অনেক উত্তম। যে লোক এ রাত্রির মহা কল্যাণলাভ হতে বঞ্চিত থাকল, সে সত্যিই বঞ্চিত ব্যক্তি। (সুনানুন নাসায়ী:২১০৬)
মহিলাদের রোজা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কিছু মাসয়ালা
গর্ভাবস্থায় রোজা :
অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে যদি কোনো মুসলমান পরহেজগার অভিজ্ঞ ডাক্তার বলেন, রোজা রাখলে তার নিজের বা গর্ভের বাচ্চার প্রাণনাশের বা মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে সেই নারী রোজা নাও রাখতে পারেন। পরে শুধু কাজা করে নিলেই হবে।
স্তন্যদানকারিনীর রোজা :
স্তন্যদানকারিনীর রোজার বিষয়টিও অনেকটাই অন্তঃসত্ত্বার রোজার মতো। অর্থাৎ স্তন্যদানকারিনী যদি নিজে রোজা রাখলে দুগ্ধপোষ্য শিশুর প্রাণনাশ বা অন্য কোনো মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে তাহলে তিনি রোজা না রাখতে পারেন। পরে কাযা করে নিতে হবে।
ওষুধ খেয়ে মাসিক বন্ধ রেখে রোজা :
মহিলাদের পিরিয়ড হওয়াটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আল্লাহ তায়ালা তাদের এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। এতে তাদের কোনো দোষত্র“টি নেই। পিরিয়ড অবস্থায় নামাজ মাফ। আর রোজা পিরিয়ড অবস্থায় রাখা নিষেধ। এ রোজা না রাখায় তাদের কোনো গোনাহ নেই। তবে পরে তা কাজা করতে হয়। এজন্য রমজান মাসে পিরিয়ড হলে তা নিয়ে মনঃক্ষুণ্ন হওয়ার কোনো যুক্তি নেই। তবে কেউ যদি শুরু হওয়ার আগেই ওষুধ-বড়ি খেয়ে পিরিয়ড বন্ধ রেখে রোজা রাখেন তবে সে রোজা সহিহ হয়ে যাবে। ফলে তা আর পরে কাজা করতে হবে না। (শামী ১/৫০৮, আলমগীরি ১/৩৮, বাদায়ে ১/৩৯, ফাতহুল কাদির ১/১৪৫, আপকে মাসায়েল ৩/২০৭)।
লিপস্টিক বা লিপজেল :
রোজা অবস্থায় নারীরা লিপস্টিক বা লিপজেল ব্যবহার করতে পারবে। তবে সতর্ক থাকতে হবে যেন মুখে চলে না যায়। যদি মুখে চলে যায়, তবে রোজা মাকরুহ হবে। গলায় স্বাদ অনুভব হলে রোজা ভেঙে যাবে। (কিতাবুল ফাতাওয়া ৩/৩৯৮)
রান্নার লবণ ও বিভিন্ন অবস্থা পরীক্ষা :
নারীরা রান্না করার লবণ ও বিভিন্ন অবস্থা পরীক্ষা করার জন্য জিহ্বার মাধ্যমে তরকারির স্বাদ নিলে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। (আল ফেকহুল মুয়াসসার, বেহেশতি জেওর)।
পানাহার ও সহবাস থেকে বিরত থাকা :
أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَىٰ نِسَائِكُمْ ۚ هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ ۗ عَلِمَ اللَّهُ أَنَّكُمْ كُنتُمْ تَخْتَانُونَ أَنفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَا عَنكُمْ ۖ فَالْآنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُوا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ ۚ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ۖ ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ ۚ﴿البقرة: ١٨٧﴾
রোযার রাতে তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস করা তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। আল্লাহ অবগত রয়েছেন যে, তোমরা আত্নপ্রতারণা করছিলে, সুতরাং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন এবং তোমাদের অব্যাহতি দিয়েছেন। অতঃপর তোমরা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর এবং যা কিছু তোমাদের জন্য আল্লাহ দান করেছেন, তা আহরন কর। আর পানাহার কর যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রোযা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত।
যদি হায়েজ শুরু বা সন্তান প্রসব হয় :পবিত্র অবস্থায় রোজা রাখার পর যদি হায়েজ শুরু হয় বা সন্তান প্রসব হয়, তাহলে রোজা ভেঙ্গে যাবে এবং পরে তা কাজা করতে হবে। চাই সেটা ফরজ বা নফল রোজা হোক।
স্বামীর অনুমতি ব্যতীত রোজা :
মহিলারা রমজান ছাড়া স্বামীর অনুমতি ব্যতীত রোজা রাখবে না। (তিরমিজি : হাদির নম্বর ৭৮২)
যে মেয়ে বা কন্যা বালেগ হয়েছে :
যে মেয়ে বা কন্যা বালেগ হয়েছে অথচ লজ্জার কারণে প্রকাশ করে না এবং রোজাও রাখে না। তাহলে তার ওপর তাওবা ও ছুটে যাওয়া রোজার কাজা করা ওয়াজিব।
হায়েজের রক্ত :
মহিলা যদি নিজের অভ্যাস অনুযায়ী বুঝতে পারে যে আগামীকাল তার হায়েজ জারি হবে। তাহলেও সে রোজা ভাঙবে না। যতক্ষণ না সে তার হায়েজের রক্ত দেখতে পায়। (আপকে মাসায়েল : খ. ৩, পৃ. ২৭৮)
হায়েজা মহিলাদের ইবাদত :
বিসমিল্লহির রাহমানির রাহিম ও শেষে আলহামদুলিল্লাহ বলতে কোনো অসুবিধা নেই। বর্তন, পিরিচ অথবা কাগজের উপর যদি শুধু কুরআনের আয়াত লিখা থাকে, তাতে হাত লাগানো যাবে না, তবে পৃথক কোনো কাপড় দিয়ে তা ধরা যাবে। হায়েজা মহিলা বাচ্চাদেরকে কুরআন শরীফ বানান করে শিক্ষা দিতে পারবে। তবে রিডিং পড়ানোর সময় ১ শ্বাসে পূর্ণ ১ আয়াত পড়াতে পারবেনা বরং শ্বাস ভেঙ্গে ১-২ শব্দ করে পড়াতে হবে।
রোজা অবস্থায় রক্ত দেওয়া নেওয়া :
রোজা অবস্থায় রক্ত দেওয়া-নেওয়া দুটোই জায়েয। এর কারণে রোজা ভাঙবে না । তাই রোজা অবস্থায় ডায়ালাইসিস করা যাবে।এর দ্বারা রোজা ভাঙবে না।- ফিকহুন নাওয়াযিল ২/৩০০ .নাকে ড্রপ, স্প্রে ইত্যাদি ব্যবহারের পর-নাকে ড্রপ, স্প্রে ইত্যাদি ব্যবহারের পর তা যদি গলার ভেতরে চলে যায়, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে। অবশ্য গলায় না গেলে বা গলায় স্বাদ অনুভূত না হলে রোজা ভেঙে যাবে না । – মাজাল্লাতু মাজমাইল ফিক্হিল ইসলামী, দশ্ম সংখ্যা ২/৪৫৪., আলমাওসূআতুত তিব্বিয়া আলফিক্হিয়া ৬২৪
রোজা অবস্থায় বিমানে পশ্চিম দিক সফর ঃ
রোজা অবস্থায় বিমানে পশ্চিম দিক সফর করার কারণে দিন বড় হয়ে যায়, তাহলেও (বিমানে বা জমিনে যেখানেই হোক তার অবস্থান স্থলে) যখন সূর্যাস্ত হবে তখনই তার ইফতারের সময় হবে। এর আগে ইফতার করা বৈধ হবে না। অবশ্য দিন বেশি বড় হয়ে যাওয়ার কারণে রোজা রাখা যদি অনেক বেশি কষ্টকর হয়ে যায়, তাহলে রোজা ভেঙ্গে ফেলার অনুমতি আছে। তবে পরবর্তী সময়ে রোজাটি কাযা করে নিতে হবে।
মহিলাদের এতেকাফ ঃ
হজরত মুহাম্মদ সা. এর সহধর্মিণীরা এতেকাফ করতেন। হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, হজরত নবী করিম (সা.) তার ইন্তেকাল পর্যন্ত রমজানের শেষ ১০ দিন এতেকাফ করতেন। অতঃপর তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর স্ত্রীরা এতেকাফ করেছেন। (বুখারি, হাদিস নং ২০২৬)
নারীদের এতেকাফের নিয়ম :
নারীরা ঘরের নামাজ ও অন্যান্য ইবাদতের জন্য নির্ধারিত স্থানে এতেকাফ করবেন। যদি পূর্ব থেকে ঘরে নামাজের জন্য এমন কোনো স্থান নির্ধারিত না থাকে তাহলে এতেকাফের জন্য একটি স্থান নির্ধারিত করে সেখানেই এতেকাফ করবেন। (মাবসূত, সারাখসী ৩/১১৯; আলবিনায়াহ ৪/৩৮৬; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৭৯; তাবয়ীনুল হাকায়েক ২/২২৬; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১১; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪৪১) রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ পুরুষের জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়া হলেও নারীদের জন্য তা মুস্তাহাব।
বিবাহিত নারীদের এতেকাফ :
বিবাহিতা মহিলারা রমজানের শেষ দশকের এতেকাফ বা অন্য সময়ের নফল এতেকাফের জন্য স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। বিবাহিতা মহিলা স্বামীর অনুমতি ছাড়া এতেকাফ করা অনুচিত। স্বামীর অনুমতি নিয়ে মহিলারা এতেকাফ করতে পারবেন। আর স্বামীদের উচিত যুক্তিসঙ্গত, গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া স্ত্রীদের এতেকাফ বারণ না করা, তাদের এতেকাফের সওয়াব থেকে বঞ্চিত না করা। (বাদায়ে ২/২৭৪। স্বামী স্ত্রীকে এতেকাফের জন্য অনুমতি দেয়ার পর তাকে আর এতেকাফে বাধা দিতে পারবে না। যদি বাধা দেয় তাহলে সে বাধা মানা স্ত্রীর কর্তব্য নয়। (শামী ৩/৪২৯, আলমগীরি ১/২১১)।
কোনো মহিলার স্বামী যদি মাজুর হয় তার সেবা-যত্নের প্রয়োজন হয়, তাহলে সে মহিলার উচিত হচ্ছে এতেকাফে না বসে বরং স্বামীর সেবা-যত্ন, দেখাশোনা করা। কারণ সওয়াবের নিয়তে স্বামীর খিদমত সেবা-যত্ন করলে এতেকাফের চেয়ে অধিক সওয়াব পাওয়া যাবে। যে মহিলার ছোট ছোট সন্তান আছে এবং তাদের লালন-পালন ও দেখাশোনার কেউ নেই এমন মহিলারও উচিত এতেকাফে না বসে সন্তানের লালন-পালন ও দেখাশোনা করা। যে মহিলার সাবালগ মেয়ে আছে। তাদের দেখাশোনার জন্য কেউ নেই। সে মহিলারও উচিত এতেকাফে না বসে বরং সাবালগ মেয়ের দেখাশোনা করা। (আহকামে রমজান ও জাকাত, ৬৪)। বর্তমানে মহিলারা খুব কমই এতেকাফ করেন। অথচ এতেকাফ অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। আর মহিলাদের জন্য এতেকাফ তো সহজও বটে। ১০ দিনের এতেকাফ সম্ভব না হলে , আংশিক করা উচিত।
Add Comment