জাতীয়ভাবে আমাদের সাধারণ একটা অভ্যাস বা প্রবণতা হচ্ছে আমরা কোনো সমস্যা বা সংকটের গভীরে যাই না। আমরা যা চোখে দেখি তা নিয়েই মাতামাতি, তর্কা-তর্কি ও গালাগালি করি। এ যেন কঠিন এক রোগের কারণ ও উপর্সগ নির্ণয় না করে সাধারণ প্যারাসিটামল দিয়ে তার প্রতিকারের চেষ্টা করা। এতে হিতে বিপরীত হয়। কঠিন রোগটি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন আর কারো তেমন কিছুই করার থাকে না। তাই রোগ বা সংকটের মূল কারণে বা গভীরে না গিয়ে যদি ভাসাভাসা (superficially) সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হয় তাতে সমস্যা না কমে বরং তা প্রকট আকার ধারন করে। এক সময় তা সমাধান ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। গত দেড় দশকে তো আমরা তাই দেখে আসলাম। দেশ গভীর রাজনৈতিক সংকটে পড়েছিল যা থেকে উদ্ধার হয়েছে ছাত্র-জনতার সফল গণ-অভ্যূত্থানের মাধ্যমে।
আর এই সংকটের একেবারে গোড়ায় ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়। এই রায়ের প্রধান কারিগর হলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। এই নিবন্ধে খুঁজবো দেশকে গভীর রাজনৈতিক সংকটে ফেলা সেই রায়ের আইনি, নৈতিক, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি। দেখবো কীভাবে এই রায় শঠতা ও গোঁজামিলে ভরপুর!
২০১১ সালের ১০ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় সর্বসম্মত ছিল না। বরং এটি ছিল গভীরভাবে (অনেকটা সমান সমানভাবে) বিভক্ত রায়। রায় দেয়ার সময় প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ছিলেন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। রায় প্রদানকারী বাকি ৬ জন বিচারপতির মধ্যে ৩ জন (যথাক্রমে বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন) তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে রায় দেন। আবার ৩ জন (যথাক্রমে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি মো. ইমান আলী) তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে রায় দেন। বিচারপতি মো. ইমান আলীর রায়টি একটু ভিন্ন ধাঁচের হলেও তাঁর রায় স্পষ্টত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে ছিল। একেবারে সমানভাবে বিভক্ত রায় বিচারপতি খায়রুল হকের কাস্টিং ভোট তথা রায় বাতিলের পক্ষে চার-তিনে মেজরিটি হয়ে এই রায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের রায় হয়।
৪:৩-এর সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়েও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আওতায় পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে মত দেয়া হয়। ওই সময় সংক্ষিপ্ত রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলেন, বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বাদ রেখে সংসদ এ সরকার পদ্ধতি সংস্কার করতে পারে। ওই সংক্ষিপ্ত রায়ের উপর ভিত্তি করে পূর্ণাঙ্গ রায় বের হবার আগেই তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করত: তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে তৎকালীন মহাজোট সরকার। অথচ পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে যে গুরুত্বপুর্ণ মত সর্বোচ্চ আদালত থেকে দেয়া হয় তা আমলেই নেয়নি সরকার। এত তড়িঘড়ি করার কি দরকার ছিল? পূর্ণাঙ্গ রায় বের হলে পুরো রায়ের ব্যাখ্যা ও চুলচেরা বিশ্লেষণ করার সুযোগ থাকতো, থাকতো সর্বোচ্চ আদালতে পূনর্বিবেচনা করার আবেদনের অধিকার। যেহেতু ৩:৩ এ সমানভাবে বিভক্ত রায় বিচারপতি খায়রুল হকের কাস্টিং ভোট তথা রায়ে মেজরিটি হয়েছিল এবং বিচারপতি খায়রুল হক যেহেতু সংক্ষিপ্ত আদেশের পরপরই অবসরে গিয়েছিলেন, সেহেতু সমূহ সম্ভাবনা ছিল পূনর্বিবেচনায় রায় পাল্টে যাবার! সংক্ষিপ্ত রায়ের উপর ভিত্তি করে তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করার কারণে সর্বশেষ এই পূনর্বিবেচনা করার আবেদনের সুযোগ ও অধিকারটিও থাকলো না।
এই রায়কে ঘিরে পর্দার আড়ালে কী যে হয়েছে তার কিছুটা আন্দাজ মেলে কয়েকটি তথ্য ও প্রমাণ থেকে। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ওপেন কোর্টে তাঁর সংক্ষিপ্ত আদেশে পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে মত দেন। কিন্তু সরকার সংক্ষিপ্ত আদেশের উপর ভর করে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পর যখন বিচারপতি খায়রুল হক পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করলেন তখন পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে যে মত দিয়েছিলেন তা আর রাখেন নি! কোনো অধিকতর বা পরবর্তী (More or further) শুনানি ছাড়া এভাবে রায় পরিবর্তন করা যায় না। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন ওঠে – কেউ কি তাঁকে চাপ দিয়েছিল? বা কারো সাথে কোনো যোগসাজসে তেমনটি করা হয়েছিল? শোনা গেছে বিচারপতি খায়রুল হক অবসরের পর রায় লিখে জমা দেয়ার পর আবার নিয়ে সংশোধন করে লিখে আবার জমা দিয়েছিলেন। এমনটি কি তিনি করতে পারেন? উন্নত বিশ্বে এভাবে রায় পরিবর্তন করাকে সিরিয়াস জুডিশিয়াল মিসকন্ডাক্ট বা বিচারসম্পর্কিত গুরুতর অসদাচরণ হিসেবে দেখা হয়।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিচারপতি খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসর গ্রহণের অব্যবহিত পূর্বে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী-সংক্রান্ত মামলার আপিল শুনানি করেন এবং একটি সংক্ষিপ্ত বিভক্ত আদেশ দেন। এর পরপরই তিনি অবসরে যান এবং ৭৪৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় লিখেন ও সাক্ষর করেন অবসরে যাবার প্রায় ১৬ মাস পরে! এখন প্রশ্ন হচ্ছে তিনি যখন খুব শিগগিরই অবসরে যাবেন এবং এর ভেতরে পূর্নাঙ্গ রায় লিখা অসম্ভব তাহলে কেনইবা এই আপিল মামলায় নিজেকে জড়ালেন? তিনি নিজেকে সরিয়ে নিতে পারতেন। সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তিনি এই মামলার আপিল শুনানিতে এত অতিউৎসাহী ছিলেন কেন? ত্রয়োদশ সংশোধনীকে হাইকোর্টের তিনজন সিনিয়র বিচারপতি সর্বসম্মতভাব বৈধ বলে ঘোষণার পর আপিল পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে পড়ে থাকলেও বিচারপতি খায়রুল হক তা হঠাৎ করে অবসরে যাবার ঠিক আগে শুনানি করার উদ্যোগ নেয়ার হেতু কি? তাও ক্ষমতাসীন দল সংসদীয় বিশেষ কমিটি গঠন করে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণের পর! বিষয়গুলো কেবল কাকতালীয় নয়।
অবসরে যাবার পর একজন বিচারপতি আর শপথের আওতায় থাকেন না। এমনকি একজন বিচারপতি অবসরে যাবার এক বছরের মধ্যে তাঁকে রাষ্ট্রের দেয়া বাড়ি, গাড়ি ও স্টাফ ছাড়তে হয়। বস্তত: উনি হয়ে পড়েন একজন সাধারণ নাগরিক। এমতাবস্থায় কিভাবে বিচারপতি খায়রুল হক অবসরে যাবার প্রায় ১৬ মাস পর অত্যন্ত স্পর্শকাতর পুরো জাতিকে নাড়া দেয়া সাংবিধানিক মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় দেন এবং তাতে সাক্ষর করেন। এটা দুনিয়ার সভ্য দেশের ইতিহাসে বিরল। বিচারপতি খায়রুল হকের উত্তরসূরি সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা (যিনি স্বয়ং বিচারপতি খায়রুল হকের সাথে একমত হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন) অবসর গ্রহণের পর রায় লেখা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী বলে ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দেন। এর আলোকে বিচারপতি খায়রুল হকের অবসরের প্রায় ১৬ মাস পরে লেখা ও সাক্ষর করা ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় কি সংবিধান পরিপন্থী হয় না?
নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রচিন্তক, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।
Email: ahmedlaw2002@yahoo.co.uk
Add Comment