রাজধানীর মতিঝিলে শাপলা চত্বরে ১৩ বছর আগে হেফাজতে ইসলামের অবস্থান কর্মসূচিতে রাতের অন্ধকারে চালানো হয়েছিল নির্মম ও নিষ্ঠুর গণহত্যা। ২০১৩ সালের ৫ মে’র মহাসমাবেশে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির তৎকালীন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা রাতের অভিযান ‘অপারেশন সিকিউর শাপলা’য় কতজন নিরীহ সাধারণ মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্রকে হত্যা করা হয় তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও এ গণহত্যার সাথে সংশ্লিষ্টদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার কোনও উদ্যোগ নেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশ না থাকায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৯ মাসেও স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে নির্দেশদাতা, নেপথ্যের কারিগর এবং সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করার কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
অন্যদিকে সেই রাতের ভয়াবহ ও নিষ্ঠুর অভিযানে ৬১ জন নিহত হওয়ার তথ্য দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’। তবে পুলিশের দাবি, রাতের অভিযানে কেউ মারা যাননি, বরং দিনভর সংঘাতে নিহত হয়েছেন ১১ জন। অভিযানে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির তৎকালীন এক ডজনেরও বেশি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। গণহত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মতিঝিল এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে গভীর অন্ধকারে সমাবেশের তিন দিক ঘিরে ফেলে রাষ্ট্রীয় তিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যৌথ অভিযান চালায়। পুলিশের ‘অপারেশন সিকিউর শাপলা’, র্যাবের ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট শাপলা’ এবং বিজিবির ‘অপারেশন ক্যাপচার শাপলা’ নাম দিয়ে অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাড়ে সাত হাজার সশস্ত্র সদস্য অংশ নেয় এবং দেড় লক্ষাধিক গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়।
গত শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলাম আয়োজিত সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, আমরা শাপলা চত্বর ও মোদি বিরোধী আন্দোলনে সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। ভারতীয় ফ্যাসিবাদ ও আওয়ামী দালালদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। দেশে ফ্যাসিস্টদের কোনও স্থান হবে না। সংখ্যালঘুদের অধিকার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি ইসলামী আইন পরিপন্থি কোনও কিছু বাস্তবায়ন না করার আহ্বান জানান।
পুলিশের কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশ না থাকায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৯ মাসেও শাপলা চত্বর গণহত্যা নিয়ে কোনও স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়নি। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার সরাসরি নির্দেশনার প্রত্যাশা করেছিল সাধারণ মানুষ। আলেম ও মাদরাসা ছাত্রদের সমাবেশে যেভাবে গণহত্যা চালানো হয়েছিল তা কোনো সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির যেসব কর্মকর্তা এ নিষ্ঠুর কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের দ্রুত শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। এজন্য স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে সরাসরি জড়িত ও নেপথ্যে নির্দেশদাতাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। দেশের মানুষ এ ধরনের গণহত্যায় জড়িতদের শাস্তি দেখতে চায় বলে মন্তব্য করেন কর্মকর্তারা। তারা আরও বলেন, বর্তমান ছাত্র-জনতার সরকার বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের জন্য এখনই উপযুক্ত সময়।
সূত্র মতে, শাপলা চত্বর গণহত্যায় নিহতের সঠিক সংখ্যা এখনও অজানা। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শহীদের সংখ্যা ৩০০-এর বেশি। পুলিশের গোপন রিপোর্টে ১৯১ জন নিহত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ ২০১৩ সালের ১০ জুন প্রথম অনুসন্ধানমূলক রিপোর্ট প্রকাশ করে। প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধানে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ৬১ জনের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করা হয়। আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের বেওয়ারিশ লাশ দাফনের রেকর্ড অনুযায়ী, ২০১৩ সালের মে মাসে অস্বাভাবিকভাবে ৩৬৭টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়, যা প্রতি মাসের গড় দাফনের চেয়ে চারগুণ বেশি।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, শাপলা চত্বর গণহত্যার পর ৬ মে ফজরের আজানের সময় লাশগুলো গুম করা হয়। র্যাব কর্মকর্তা লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান ঘটনাস্থল থেকে লাশ সরানোর নেতৃত্ব দেন। তিনি অ্যাম্বুলেন্স ও সিটি করপোরেশনের গাড়িতে করে লাশ গুম করেন। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান জানান, তিনি নিজ চোখে পাঁচ ট্রাকে লাশ সরাতে দেখেছেন।
অন্য একটি সূত্রে দাবি করা হয়, সে সময় মাতুয়াইল ও পিলখানার দিকে লাশভর্তি কয়েকটি গাড়ি যায়। জুরাইন ও আজিমপুর কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ দাফন হলেও কোনও রেকর্ড রাখা হয়নি। পরে দমকল বাহিনী ও ওয়াসার পানির গাড়ি এনে শাপলা চত্বর ধুয়ে আলামত নষ্ট করে দেওয়া হয়। গণহত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। ঢাকায় এমন ৫৩টি এবং সারা দেশে ৮০টির বেশি মামলায় হেফাজতের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। মাদরাসাগুলোতে হানা দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়, কিছু প্রকাশ করা হলে রেহাই মিলবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আলেম-ওলামা ও ছাত্রদের সম্পূর্ণ চুপ থাকতে হুকুম দেয়।
২০১৩ সালের ৫ মে রাতটি ছিল রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে সংগঠিত এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের রাত। বিদ্যুৎ বন্ধ করে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির যৌথ অভিযানে মতিঝিল এলাকায় ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। গুলি, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেডে আলেম-ওলামা, মাদরাসা ছাত্র ও এতিম শিশুরা নিহত ও আহত হন। অনেকেই এ ঘটনার তুলনা করেন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সার্চলাইট অভিযানের সঙ্গে।
শেখ হাসিনার নির্দেশে শাপলা চত্বর ক্লিয়ার করতে যেসব কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন: আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার, অতিরিক্ত আইজিপি শহীদুল ইসলাম, র্যাবের ডিজি মোখলেসুর রহমান, ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ, র্যাব-১০ অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান, র্যাব-৩ মেজর সাব্বির, র্যাব-১ পরিচালক লে. কর্নেল কিসমত হায়াত, র্যাব-৪ পরিচালক কামরুল হাসান, বিজিবির কর্নেল এহিয়া আজম খান, হাইওয়ে রেঞ্জের ডিআইজি আসাদুজ্জামান মিয়া, এসবির অতিরিক্ত ডিআইজি মাহবুব হোসেন, মতিঝিল বিভাগের এডিসি এসএম মেহেদী হাসান, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল জলিল মণ্ডল, যুগ্ম কমিশনার শেখ মারুফ হাসান, উপকমিশনার আনোয়ার হোসেন, এডিসি আসাদুজ্জামান, এডিসি মাইনুর হাসান, রমনার এডিসি মঞ্জুর রহমান, ডিবির এডিসি মশিউর রহমান, ডিবি দক্ষিণের এডিসি নাসির উদ্দিন খান, লালবাগের তৎকালীন ডিসি হারুনুর রশীদ ও উপকমিশনার খান মোহাম্মদ রেজওয়ান।
মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুল মতিন ইনকিলাবকে বলেন, শাপলা চত্বরে হেফাজতের অবস্থান কর্মসূচিতে যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, তার বিচার বিভাগীয় স্বাধীন তদন্ত হওয়া উচিত। একজন সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে এ তদন্ত হতে পারে। কারণ ৫ মে’র ঘটনায় কতজন সাধারণ, নিরীহ, নিরস্ত্র মাদরাসা শিক্ষক ও ছাত্র নিহত হয়েছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি। এ ধরনের হত্যাকাণ্ডকে আওয়ামী লীগ সরকার বৈধতা দিলেও এটি ছিল একটি বড় ধরনের রাষ্ট্রীয় গণহত্যা। বিদ্যুৎ বন্ধ করে, মিডিয়াকে নিষ্ক্রিয় করে এ হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে।
ফিরে দেখা যায়, ১৩ বছর আগে ঢাকার শাপলা চত্বরে কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি এবং নারী নীতির বিরোধিতা করে ১৩ দফা দাবি তুলে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। ৫ মে’র দিনভর উত্তেজনার পর রাতে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে তৈরি হয় এক ভীতিকর পরিবেশ। রাত দেড়টার দিকে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি প্রথমে হাতমাইক দিয়ে সরে যেতে বললেও বক্তব্য চলতে থাকে। রাত পৌনে তিনটায় মূল অভিযান শুরু হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যে শাপলা চত্বর ঘিরে ফেলে তারা। পরে দেখা যায়, চারটি লাশ কাফনের কাপড়ে মোড়ানো অবস্থায় পড়ে আছে।
হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা সাজিদুর রহমান জানান, শহীদের সংখ্যা তালিকাভুক্ত করতে তারা একটি কমিটি গঠন করেছেন। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণের কারণে তারা কাজটি সম্পূর্ণ করতে পারেননি। তবে প্রাথমিকভাবে তাদের কাছে ৭০-৮০ জন নিহতের তথ্য রয়েছে। তাদের দাবি, এ গণহত্যা পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংসতাকেও ছাপিয়ে গেছে।
Add Comment