জাতীয়

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এই মুহূর্তে করণীয় : প্রফেসর ড. মো. সদরুল আমিন, উপদেষ্ঠা, সিএইচআরএম

বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থার অবক্ষয় চরমে পৌঁছাচ্ছে। সামপ্রতিক  মিটফোর্ড, গোপালগঞ্জ ও অন্যান্য ক্রমবর্ধমান ডজনখানেক স্থানের সরকার অনিয়ন্ত্রিত সংঘর্ষ-হত্যার ঘটনা এর উদাহরণ। দুর্বল অর্থনীতি ও কম শিক্ষার দেশে এ যেন এক কঠিন সমস্যা। তবে এর সঠিক সমাধানও আছে, যার জন্য সমস্যা সৃষ্টির গোড়ার কারণটির উপর জোর দিতে হবে। এখানে তাই বর্ণনা করছি। বৈষম্য ও কোটা আন্দোলনের দাবি মানার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রচণ্ড জেদ দেখিয়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে রাজাকার গালির কথা বলার জেরে আন্দোলনকারী ছাত্রদের সঙ্গে অভিভাবক-জনতা যুক্ত হয়ে গেল। তখন দাবির কয়েক দফা হয়ে গেল- ‘একদফা, এক দাবি শেখ হাসিনা কবে যাবি’। বলাই বাহুল্য তখন দাবি মেনে নিলে পরবর্তী কোনো পরিস্থিতিই সৃষ্টি হতো না। যা হোক একদফা দাবির সঙ্গে তখন শেখ হাসিনার কাছে এমন কোনো দাবি ছিল না যে, আমরা সংবিধান ও প্রশাসনিক (পুলিশ ও কৃষি ব্যতীত) সংস্কার ও ঐক্য চাই। আমরা একটি নতুন রাজনৈতিক দল ও জাতীয় মানের প্রতীক চাই। শেখ হাসিনা সরে গেলে তৎস্থলে গঠিতব্য অস্থায়ী উপদেষ্টা সরকারে সংশ্লিষ্ট আন্দোলনে অক্রিয়, এনজিও, এলাকাভিত্তিক ও প্রবাসী/বিদেশি বিশেষজ্ঞ সংযুক্ত করতে চাই। বাস্তবে প্রধান উপদেষ্টার উদ্যোগে তাই করা হলো। উপদেষ্টা সরকারের একমাত্র কাজ ছিল ন্যূনতম সময়ের মধ্যে যথানিয়মে একটি নির্বাচন দিয়ে সংসদীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে উপদেষ্টা পদের কার্যাবলী উপদেষ্টা ও বিশেষ সহকারীদের পছন্দ হয়ে যায়। বলে তারা মরিয়া হয়ে আটঘাট বেঁধে স্থল-জল অন্তরীক্ষে সকল পথে নির্বাচন বিলম্বিত করার জন্য দেশের পরিবেশ বিনষ্ট করার উন্মত্ত কার্যক্রম সৃষ্টি ও উৎসাহিত করতে লেগে যায়। বর্তমানে দেশে এই পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য কিছু তথ্য বিশ্লেষণ ও পরামর্শ তুলে ধরা হলো। বর্তমান সরকার যখন শুরুতেই দেশের ৬৪% মানুষের প্রাথমিক উৎপাদন পেশাগত বিভাগ তথা কৃষি বিভাগে কোনো উপদেষ্টা নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে নাই, তখনই  বোঝা গিয়েছিল যে, দেশের ও প্রবাসী কিছু তাত্ত্বিক মানুষ সংবলিত এই উপদেষ্টা সরকারের দেশ সম্পর্কে কোনো ধারণা নাই। কারণ দেশে বর্তমানে সরকার, রাজনীতি ও নির্বাচন ও রাজনৈতিক দল নিয়ে যে কূট-প্যাঁচাল শুরু হয়েছে তা দেশের সর্বনাশ ডেকে আনবে। বিষয়টি গুছিয়ে বলা দরকার। সরকার ও ২-৩টি রাজনৈতিক দল জোরালোভাবে চাচ্ছে নির্বাচন পিছিয়ে যাক, একটি দল চাচ্ছে নির্বাচন হোক। জনগণের রিঅ্যাকশনও নির্বাচনের পক্ষে। দেশের জনগণের অধিকাংশের ধারণা যে, দুর্বলতম সরকার ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির প্রেক্ষিতে নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা না করে অবিলম্বে দেশে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে শিডিউল ঘোষণা করতে হবে। এর যেকোনো বিকল্প প্রচেষ্টা বর্তমান সরকার চক্রের সুনাম তলানিতে যাবে, তারা যে যার দেশে-প্রবাসে চলে যাবেন। দেশে শুরু হবে আরেকটি মারাত্মক আন্দোলন। আমি আমার “গভর্ন্যান্স ইন বাংলাদেশ” (সূত্র: নেত্রকোনার হাসি চাই না পৃ: ভূমিকা ১০) পুস্তকে ৬ বছর আগে দেশের ৭টি সংসদীয় নির্বাচনের সংকট বিষয়াবলী বিশ্লেষণ করে বলেছিলাম” যত কঠিন বাস্তব হোক না কেন এ দেশের স্বাধীন সত্তা ও ভাবমূর্তি সুরক্ষার জন্য আগামী সাংবিধানিক নির্বাচন কমিশনার এমনভাবে নির্বাচন (পরিবেশ সৃষ্টি) অনুষ্ঠান করবেন যে, যাতে নির্বাচনের ফলাফল হতে পারে নিম্নরূপ: সকল দল জোটবিহীনভাবে- (গণতন্ত্র সদস্য কম্পোজিশন) প্রধান দল ১৫১-১৬০ জন সদস্য, দ্বিতীয় প্রধান দল ১০০-১১০ জন সদস্য, তৃতীয় দল ১৫-২৫ জন সদস্য, বাকি অন্যান্য। এর মধ্যে থাকবে ২৪০-২৫০ রাজনীতি সম্পৃক্ত ব্যক্তি, স্বাধীন পেশা ও কৃষক ঘরানা ২৫-৩৫, বাকি অন্যান্য। স্নাতক: স্নাতকোক্তর অনুপাত ৫০ : ৫০ (প্রায়)। এতে জনগণ গণতন্ত্রের পূর্ণ সুবিধা ভোগ করার সুযোগ পেতে পারে।
উল্লেখ করা যায় তখনকার ’২৪-এর নির্বাচনে এই পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় নির্বাচিত সরকার অল্প দিনেই পতন ঘটে ও সরকার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।

দেশে স্থায়িত্বশীল সরকারের একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নির্বাচনের পূর্বে দেশে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা।
দেশে নির্বাচন ও গভর্ন্যান্স সুরক্ষার জন্য বর্তমান সরকার সংস্কার কার্যক্রম রিহার্সাল দিচ্ছে, যা কোনো অবস্থাতেই জনআস্থা পাচ্ছে না। নির্বাচন পরিবেশ সৃষ্টির বা বহাল করার জন্য ঘটা করে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রয়োজন নাই। বর্তমান বিধিবিধান প্রয়োজনীয় সমন্বয় করেই তা করা সম্ভব। এখানে আমি সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।
১. ব্যবসায়িক প্রার্থী কোয়ালিফাই করা: সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার অনুরূপ কোনো ব্যবসায়ী নির্বাচন করতে হলে তাকে ব্যবসায়ী পদ থেকে পদত্যাগ করে আসতে হবে। এতে স্বার্থান্বেষী অথচ অনুপযুক্ত প্রার্থীর সংখ্যা ও নির্বাচনে অস্থিরতা অনেক কমে যাবে।
২. নির্বাচনের প্রার্থী আইন: বর্তমানে নির্বাচনের বর্তমান প্রার্থী আইন ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
৩. সংসদ সদস্যের সংসদীয় আওতা: বর্তমানে সংসদ সদস্যের সংসদীয় আওতাবহির্ভূত কাজ থেকে সরিয়ে রাখতে হবে।
৪. আর্থিক ও অঢেল সুযোগ দান: উন্নয়ন বরাদ্দ, গাড়ি, প্লট/ফ্ল্যাট, বিদেশ গমন, যেখানে সেখানে প্রতিষ্ঠান/ অবকাঠামো স্থান নির্ধারণ, উপদেষ্টা ও প্রকল্প/ চাকরি দরখাস্ত ফরোয়ার্ডিং কর্তা বানানো বন্ধ করতে হবে।
৫. সংসদ সদস্যের প্রধান কাজ: সংসদ সদস্যের প্রধান কাজ হিসেবে আইন প্রণয়ন কাজকে প্রাধান্য দিতে হবে।

আশা করি, এসব পরামর্শ প্রতিপালন ও প্রজ্ঞাপন জারি করলে নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রার্থীসৃষ্ট সমস্যা থেকে অনেকটা রেহাই পাবেন। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
উপসংহার: নির্বাচন নষ্ট উপদেষ্টার লোভে, নির্বাচন দুষ্ট প্রার্থীর কারণে ইত্যাদি সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে বর্ণিত পরামর্শগুলো উপকারী হতে পারে। দেশে অনতিবিলম্বে নির্বাচন না দিলে পরিস্থিতি এমনভাবে আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে যা অতীতে যায় নাই, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি।

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১
১৩১৫১৬১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭৩০৩১