যাকাত মানে সমৃদ্ধি, ক্রমবৃদ্ধি ও পবিত্রতা
যাকাত আদায়ের মাধ্যমে ব্যক্তির অবশিষ্ট সম্পদ পবিত্র হয়ে যায়। আসমানি রবকত এসে সমৃদ্ধ করে। আর পরকালীন পাথেয় হিসেবে ক্রমবৃদ্ধি হতে শুরু করে। পবিত্র কুরআন-হাদিসে ভূরিভূরি যাকাত প্রদানের গুরুত্ব এবং অনাদায়ের ভয়াবহ পরিণামের বর্ণনা এসেছে। কুরআন মজিদ বত্রিশ জায়গায় যাকাতের আলোচনা করেছে। তন্মধ্যে আটশ জায়গায় নামায এবং যাকাতের সমন্বিত আলোচনার মাধ্যমে বিত্তবানদের চিত্তাকর্ষণ করা হয়েছে। কারণ শারীরিক ইবাদতের মধ্যে যেমন নামায শ্রেষ্ঠ তেমনি আর্থিক ইবাদতের মধ্য শ্রেষ্ঠ হলো যাকাত। প্রিয় রসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পর কিছু লোক ইসলামের মৌলিক আহকাম যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানালো। যাকাত ফরয হওয়াকে অস্বীকার করে বসতে শুরু করলো অথচ যাকাত ফরয হওয়া অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত। এজন্য হাদিস বিশারদ ও সম্মানিত ফকিহগণ যাকাত অস্বীকারকারীদের কাফির এবং তা ফরয জেনেও আদায় করবে না, সে ফাসিক হওয়ার মধ্যে বিবেচনা করেন। [ফতোয়া-ই আলমগীরি যাকাত অধ্যায়।] ধর্মের এ মৌলিক বিধির অস্বীকারকারীদের সাথে ইসলামের প্রথম খলিফা সায়্যিদুনা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর যুদ্ধের মনস্থির করেন। দ্বিতীয় খলিফা সায়্যিদুনা হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুসহ অন্যান্য সাহাবিগণ বললেন, এখন যাকাত অস্বীকারকারীদের সাথে যুদ্ধ করার উপযোগী সময় নয়। সিদ্দীকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বললেন, “আল্লাহর শপথ! যদি কোনো ব্যক্তি একটি রশি কিংবা কোনো বকরীর বাচ্চা যাকাত হিসেবে দিতে অস্বীকার করে, যা সে হুযুর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে দিত, তাহলে আমি তার সাথে যুদ্ধ করব।” [তারিখুল খোলাফা, আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতি (রহ.), পৃ.৫১।]
যাকাত যাদের উপর ফরজ
যাকাতের এ বিধান কেবল স্বাধীন, প্রাপ্তবয়স্ক ও সম্পদশালী মুসলমানদের উপর ফরয। সম্পদের উপর যাকাত ফরয হওয়ার জন্য প্রথমত সম্পদের মালিকানা সুনির্দিষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ হওয়া জরুরী। দ্বিতীয়ত সম্পদ অবশ্য বর্ধনশীল বা প্রবৃদ্ধমান হতে হবে। এ ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পাওয়ার যোগ্যতা থাকাই যথেষ্ট, বৃদ্ধি পাওয়া জরুরী নয়। তৃতীয়ত নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা আবশ্যক।
যাকাতের নিসাব
যাকাতের নিসাব হলো-প্রয়োজনীয় ব্যয় বাদ দিয়ে সাড়ে বায়ান্ন তোলা (ভরি) রৌপ্য বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা স্বর্ণরৌপ্যের সমমূল্যের সম্পদের মালিক হওয়া অথবা উভয়টি মিলে সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ কিংবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার মূল্যের সমান বা সব সম্পদ মিলে উভয়টি থেকে যে কোনো একটির নিসাবের সমান হলে যাকাত দিতে হবে। মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে গরিবের জন্য যা অধিকতর লাভজনক, তার মূল্য ধরতে হবে। চতুর্থত নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ একবছর মালিকানায় থাকতে হবে। [জামে‘উস সগির, মাবসূত, কানযুদ দাক্বাইক, দুররূল মুখতার, হেদায়া, রদ্দুল মোহতার, মুখতাসারুল কুদূরি, নুরুল ঈদ্বাহ সহ ফিহকের বিভিন্ন গ্রন্থের যাকাত অধ্যায়।]
স্বর্ণালংকার, ব্যবসায়িক পণ্য, ফসলশস্য ও গরুছাগল, উট এবং মহিষের যাকাত হিসাব করে শরিয়‘ত কর্তৃক নির্ধারিত অংশ নিয়্যত সহকারে নির্দিষ্ট খাতে প্রদানের তাগাদা মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকেই অবধারিত। আদায়ে গড়িমসি যেমন পাপ, তেমনি যথাযথ খাতে না দিলেও আদায় হবে না যাকাত।
যাকাতের খাত সমূহ
সাহাবিয়ে রসুল সায়্যিদুনা হযরত যিয়াদ ইবন হারিস আসসুদাঈ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত ; তিনি বলেন, একদা একব্যক্তি নবীজি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে যাকাতের জন্য প্রার্থনা করলেন। আল্লাহর প্রিয় হাবিব তাকে (সুস্থসবল দেহবিশিষ্ট দেখে) বললেন, “দেখ! যাকাতের খাত নির্ধারণ মহান আল্লাহ কোনো নবী কিংবা অন্যকারো হাতে না রেখে স্বয়ং নিজেই আটটি ভাগে ভাগ করে দিয়েছেন। তুমি ওই আট প্রকারের অন্তর্ভুক্ত থাকলে আমি তোমাকে যাকাতের অংশ দিতে পারি, অন্যথা নয়।” [সুনানু আবু দাউদ, যাকাত অধ্যায়। মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং-১৮৩৫।]
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে মহান রাব্বুল আলামিন যাকাত প্রদানের আটটি খাত নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে, “যাকাত তো সেসব লোকেরই জন্য, যারা অভাবগ্রস্ত, নিতান্ত নিঃস্ব, যারা তা সংগ্রহ করে আনে, যাদের অন্তরসমূহকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা হয়, ক্রীতদাস মুক্তির ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আর আল্লাহ পাক সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” [আল-কুরআন, সুরা তাওবা, আয়াত : ৬০।]
আয়াতের আলোকে যাকাত বণ্টনের আটটি খাত হলো-১. ফকির (যার নিতান্ত সামান্য পাথেয় আছে), ২. মিসকিন (যার কিছুই নেই), ৩. যাকাত সংগ্রহের কার্যে নিয়োজিত ব্যক্তি (তার পারিশ্রমিক অনুযায়ী), ৪. দ্বীন ইসলামের প্রতি চিত্তাকর্ষণে কোনো অমুসলিম কিংবা ইসলামে অটল রাখার্থে নও মুসলিম, ৫. দাসদাসীর মুক্তি, ৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণমুক্তি, ৭. একান্ত ও শরিয়ত সম্মত আল্লাহর পথে যুদ্ধের ক্ষেত্রে এবং ৮. রিক্তহস্ত মুসাফির।
মানবতার জন্য যাকাত
দেশের সংকটাপন্ন এ দুরবস্থায় ধনাঢ্যদের যাকাত আদায়ের মোক্ষম সুযোগ। অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে যাকাতের যথাযথ বণ্টনব্যবস্থা এ ক্রান্তিলগ্নে সুফল বয়ে আনবে। পুঞ্জিভূত সম্পদের অট্টালিকা না গড়ে দিনমজুর, শ্রমিক ও ফকির-মিসকিনদের প্রতি তাদের প্রাপ্য হিসেবে যাকাত প্রদান করে নিজেদেরকে কঠিন আযাবের সম্মুখীন হওয়া থেকে বিরত রাখতে এখনই যেন আমরা উদ্যোগী হই।
যাকাত গরিবের অধিকার
যে কথাটা মনে রাখা উচিত, যাকাত কোনো প্রকারের উপহার, উপঢৌকন কিংবা দয়ার্চনা নয়, এটি গরিবের হক। অসহায়ের অধিকার। তাই যার যে অধিকার, তা যথাযথ আদায়ে আমরা সচেষ্ট হই। যারা যাকাত না দিয়ে কার্পণ্যবশত সম্পদ জমা করে রাখবে, আল-কুরআনের আলোকে সেসব সম্পদ অচিরেই কিয়ামত দিবসে তাদের গলায় বেড়ি হবে। বুখারি ও মুসলিম শরিফের এক বর্ণনায় এও এসেছে যে, যাকাত অনাদায় সম্পত্তিকে কিয়ামতের ময়দানে বিষধর সাপে রূপ দিয়ে কৃপণ ধনবানদের গলায় জড়িয়ে দেয়া হবে। [সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১১১, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২৩৪৩।]
জিলহজ মাসের ফজিলত ও আমল
জিলহজ মাসের চাঁদ ওঠার পর থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত দিনে রোজা পালন করা, রাতে বেশি বেশি ইবাদত করা উচিত। যথা: নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-দরুদ, তওবা-ইস্তিগফার ইত্যাদি। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জিলহজের ১০ দিনের ইবাদত আল্লাহর নিকট অন্য দিনের ইবাদতের তুলনায় বেশি প্রিয়, প্রতিটি দিনের রোজা এক বছরের রোজার মতো আর প্রতি রাতের ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের মতো’ (তিরমিজি, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা: ১৫৮)।
আরাফার দিন, অর্থাৎ ৯ জিলহজ নফল রোজা রাখা বিশেষ সুন্নত আমল। তবে আরাফায় উপস্থিত হাজি সাহেবদের জন্য এই রোজা প্রযোজ্য নয়। হজরত আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আরাফার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী যে আল্লাহ তাআলা তার (রোজাদারের) বিগত এক বত্সরের ও সামনের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন’ (তিরমিজি, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা: ১৫৭)। জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রতি ফরজ নামাজের পর একবার তাকবির বলা ওয়াজিব (ইলাউস সুনান, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা: ১৪৮)। জিলহজের ১০, ১১ ও ১২ যেকোনো দিন, কোনো ব্যক্তির মালিকানায় নিত্যপ্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা বা এর সমমূল্যের সম্পদ থাকলে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। পুরুষ ও নারী সবার জন্য এ বিধান প্রযোজ্য (ইবনে মাজাহ: ২২৬)। হজরত জায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে সাহাবাগণ বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! এ কোরবানি কী?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘তোমাদের পিতা ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত।’ তাঁরা পুনরায় বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! তাতে আমাদের জন্য কী সওয়াব রয়েছে?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি সওয়াব রয়েছে।’ তাঁরা আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! ভেড়ার লোমের কী হুকুম? (এটা তো গণনা করা সম্ভব নয়)’, তিনি বললেন, ‘ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি সওয়াব রয়েছে’ (ইবনে মাজাহ: ২২৬)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে’ (ইবনে মাজাহ: ২২৬)।
Add Comment