আন্তর্জাতিক

বৃটিশ ইতিহাসে এই প্রথম ৪৫ দিনে একজন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলেন

উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সবই যেন বিরুদ্ধে চলে গেছে। এমন দ্বন্দ্ব, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে পদত্যাগ করেছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস। পূর্বসূরি বরিস জনসনের কাছ থেকে দায়িত্ব নেয়ার মাত্র ৪৫ দিনের মধ্যে তাকেও বিদায় নিতে হলো। এর মধ্যদিয়ে তিনি হলেন বৃটেনের ইতিহাসে ক্ষমতায় থাকা সবচেয়ে কম সময়ের প্রধানমন্ত্রী। পদত্যাগ করলেও নতুন নেতা নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার কথা জানিয়েছেন। তারও আগে পদত্যাগ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রেভারম্যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তিনিই সবচেয়ে কম সময় এই মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ বিষয়ে ইউরোপিয়ান প্রেসগুলো বলছে, ব্রেক্সিটের ফলে এসব ঘটছে বৃটেনে।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন বৃটেনে যত দ্রুত সম্ভব স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি ব্রাসেলসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এক সম্মেলনে সাংবাদিকদের বলেছেন, সর্বোপরি আমরা স্থিতিশীলতা চাই।

ব্যক্তিগতভাবে একজন কলিগের বিদায় আমার জন্য সব সময়ই বেদনার। ওদিকে লিজ ট্রাসের বিদায়ের মিনিটের মধ্যেই নতুন আরেক অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরেছে বৃটেনকে। তা হলো কনজারভেটিভ দলের নতুন নেতা নির্বাচন। কে হবেন এই নেতা, যিনি হবেন নতুন প্রধানমন্ত্রী! তবে এ দৌড়ে সম্ভবত এগিয়ে থাকতে পারেন লিজ ট্রাসের প্রতিদ্বন্দ্বী ঋষি সুনাক, পেনি মর্ডন্ট, প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী বেন ওয়ালেস। নতুন নেতৃত্বের লড়াইয়ের ফল আগামী শুক্রবার পাওয়া যেতে পারে বলে জানিয়েছেন স্যার গ্রাহাম ব্রাডি। তবে এমন পরিস্থিতিতে অবিলম্বে নতুন জাতীয় নির্বাচন ঘোষণা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিরোধী লেবার দলের নেতা কিয়ের স্টর্মার, লিব ডেমের নেতা এডওয়ার্ড ডাভে এবং স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি।

ওদিকে কয়েকদিনে ভয়াবহ প্রতিকূলতার পর বৃহস্পতিবার ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের ১৯২২ কমিটি ও এর চেয়ারম্যান স্যার গ্রাহাম ব্রাডিকে ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে ডেকে নেন লিজ ট্রাস। তাদের সঙ্গে বৈঠকের পরই ডাউনিং স্ট্রিট থেকে বিবৃতি দেয়া হয়। এতে মিস লিজ ট্রাস বলেন, মারাত্মক অর্থনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক অস্থিতিশীলতার সময়ে আমি ক্ষমতায় এসেছিলাম। কীভাবে বিল পরিশোধ করবেন তা নিয়ে পরিবারগুলো এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল উদ্বিগ্ন। এ পরিস্থিতির পরিবর্তনের ম্যান্ডেট নিয়ে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি আরও যুক্ত করেন, আমরা বিদ্যুৎ বিলের বিষয়ে পরিষেবা দিয়েছি। যে ম্যান্ডেট নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তা পূরণ করতে পারেননি বলে স্বীকার করেন তিনি। লিজ ট্রাস বলেন, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন নেতা নির্বাচন করা হবে। এর মাত্র ২৪ ঘণ্টার কিছু কম সময় আগে তিনি বুধবার হাউজ অব কমন্সে এমপিদের কাছে বলেন, তিনি একজন লড়াকু, ছেড়ে যাওয়ার মানুষ নন। কিন্তু তিনি কথা রাখতে পারলেন না। তাকে পদত্যাগ করতেই হলো।

গত মাসে সাবেক চ্যান্সেলর কওয়াসি কর্টেং মিনি বাজেট ঘোষণা করেন। তাকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খল এক অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ কারণে এই চ্যান্সেলরকে বরখাস্ত করেন তিনি। উদ্ভূত উত্তাল পরিস্থিতিতে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। নতুন চ্যান্সেলর নিয়োগ করেন জেরেমি হান্টকে। কিন্তু রাজনীতিতে যে তুষের আগুন জ্বলছিল তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে বুধবার। এদিন বিরোধী লেবার দলের আনা ‘ফ্রাকিং’ ভোটকে কেন্দ্র করে হাউজ অব পার্লামেন্ট অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের কমপক্ষে এক ডজন এমপি প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে বসেন। এর বাইরে অন্য অনেকে ব্যক্তিগতভাবে বলতে থাকেন, প্রধানমন্ত্রীর সময় শেষ হয়ে গেছে। বৃটিশ মিডিয়াগুলোও আভাস দেয়- প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস ‘ফ্রিফল’ অবস্থায় আছেন।

যেকোনো মুহূর্তে তিনি সুতা ছিঁড়ে জমিনে পড়ে যেতে পারেন। এমন এক পরিস্থিতিতে ১৯২২ কমিটির চেয়ার স্যার গ্রাহাম ব্রাডিকে চিঠি লেখেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এমপি। তারা পরিষ্কার করে তাকে জানান যে, প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা হারিয়েছেন। ওদিকে সোমবার নতুন চ্যান্সেলর জেরেমি হান্ট ঘোষণা করেন, দুই বছর আগে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল জ্বালানি মূল্য ৬ মাসের জন্য কর্তন করা হবে। একই সঙ্গে আয়ের বেসিক রেট এক পেন্স কমানোর পরিকল্পনা বাদ দেয়া হবে।  কিন্তু এ ঘোষণাও পরিস্থিতিকে শান্ত করতে পারেনি। লিজ ট্রাসের অর্থনৈতিক কর্মসূচিকে লিজ ট্রাসের উত্থানের মূল হিসেবে দেখা হয়েছিল। জেরেমি হান্টের এই বিবৃতির পর প্রধানমন্ত্রীর অফিসের একজন মুখপাত্র এটা প্রত্যাখ্যান করতে অস্বীকৃতি জানান যে, নতুন চ্যান্সেলরের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা সত্ত্বেও লিজ ট্রাস প্রায় পদত্যাগ করতে যাচ্ছিলেন।

কিন্তু বুধবার থেকে ২৪ ঘণ্টা সবচেয়ে বিপর্যয়কর হয়ে ওঠে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ করে লিজ ট্রাসের প্রধানমন্ত্রিত্ব অশান্ত হয়ে উঠেছে বলে কড়া সমালোচনা করেন সুয়েলা ব্রেভারম্যান। তিনি পদত্যাগের আগে সুরক্ষিত ডকুমেন্ট একটি প্রাইভেট ইমেইলে পাঠানোর কথা স্বীকার করেন। লিজ ট্রাসের ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের মেয়াদ ৬ সপ্তাহে চার জন বড় মন্ত্রী পদ হারিয়েছেন। ব্রেভারম্যান পদত্যাগ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাউজ অব কমন্সে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয় বিরোধী লেবার পার্টির আনা ‘ফ্রাকিং ভোটকে’ কেন্দ্র করে। এই ভোটকে বিবেচনা করা হয় সরকারের বিরুদ্ধে আস্থা ভোট হিসেবে। এই ভোট পাস হলে সরকার, চিপ হুইপ ও ডেপুটি চিফ হুইপকে পদত্যাগ করতে হবে বলে বিবেচনা করা হয়। সরকারের একটি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে এই ভোট এনেছিল বিরোধী লেবার দল। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল একে অনাস্থা ভোট হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে। নিজ দলের এমপিদেরকে এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিতে বাধ্য করে। ভোট চলাকালীন লবিতে কনজারভেটিভ এমপিদের ধস্তাধস্তির ছবি প্রকাশ হয়েছে। শারীরিকভাবেও কোনো কোনো এমপিকে প্রহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন লেবার দলের এমপি ক্রিস ব্রায়ান্ট। কিন্তু লিজ ট্রাসের ব্যবসা বিষয়ক মন্ত্রী জ্যাকব রিস-মগ এমন দাবি প্রত্যাখ্যান করেন।

লিজ ট্রাস পদত্যাগ করার আগে গতকাল অনলাইন বিবিসি জানায়, উদ্ভূত পরিস্থিতি টালমাটাল হয়ে পড়েছে প্রধানমন্ত্রীর জন্য। বিরোধীদলীয় এমপিরা অভিযোগ করেছেন কনজারভেটিভ দলের কিছু সদস্যকে ফ্রাকিং ভোটের সময় অবমাননা করা হয়েছে। তাদের ওপর হাত তোলা হয়েছে। এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন একজন মন্ত্রী। কিন্তু তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন কনজারভেটিভ দলের অনেক এমপি। তারা নিজেদের দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এ অবস্থাকে বিপর্যয়কর বলে অভিহিত করেন কনজারভেটিভ দলের এমপি চার্লস ওয়াকার। তাকে দেখে বেশ ক্ষুব্ধ মনে হয়েছে।

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১
১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭৩০৩১