শিক্ষা

বিশ্ব মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সঃ) মদীনা সনদের তাৎপর্য

জান্নাতুল মাওয়া শাহানা, যুগ্ম সম্পাদক, ঢাকা উত্তর, সিএইচআরএম ::
২৭.১০.২০২২ ইং তারিখে অনুষ্ঠিত সেমিনারে আমার উপস্থাপিত বক্তব্য হুবহু নিম্নে পেশ করা হলো। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষাবিদ, গবেষক আমেরিকান সিটিজেন আলহাজ্ব অধ্যক্ষ মানজুরুল ইসলাম, প্রধান আলোচক ছিলেন বহু আইন গ্রন্থের লেখক আলহাজ্ব লায়ন ড. গাজী সিরাজুল ইসলাম এবং মূল আলোচক ও সমন্বয়কারী ছিলেন আলহাজ্ব লায়ন ড. মোজাহেদুল ইসলাম মুজাহিদ, অন্যান্য অতিথিদের মধ্যে আলোচনা পেশ করেন-ব্যারিস্টার মোহাম্মদ ফজলুল করিম মন্ডল জুয়েল, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী নেতা এডভোকেট শেখ তাহসিন আলী, সাবেক সরকারী কর্মকর্তা এস এম শিব্বির আহমেদ, বিশিষ্ট সমাজসেবক পিএইচডি গবেষক প্রখ্যাত আয়কর আইনজীবী কাজী মিজানুর রহমান, সমাজসেবক ও শিল্পপতি আলহাজ্ব লায়ন মোঃ ইকবাল লিটন, মাজসেবক ও শিল্পপতি আলহাজ্ব শিহাব উদ্দিন আহমেদ বিশিষ্ট সমাজসেব বাধন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সাফায়েত হোসেন, মানবাধিকার ফেরিওয়ালা নবাব সালেহ আহমদ, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এম এম মিজানুর রহমান, পারভীন আক্তার প্রমুখ ।
বিশ্ব মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সঃ) মদীনা সনদের তাৎপর্য ঃঃ
আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালার দরবারে লাখো শুকরিয়া, মস্তক অবনত চিত্তে সবটুকু আবেগ ও ভালোবাসা দিয়ে যে আল্লাহ আমাদের কে দয়া দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং ভারসাম্য জিবন দিয়েছেন। দরুদ ও সালাম পেশ করছি সে ফেয়ারে হাবিব মুহাম্মদ ও আহমদ মুস্তফা (সাঃ) প্রতি যাঁর মাধ্যমে আমরা পেয়েছি সুন্দর একটা জিবন ব্যবস্থা
মহানবীর সাল্লাহু সালাম এর মদিনায় হিজরতের পর এক দিকে যেমন ইসলামিক মুসলিম উম্মাহ গঠিত হয় অন্যদিকে তেমনি ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিও প্রতিষ্ঠা পায়। এটি ইসলামের প্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে স্বীকৃত।বিশ্বের ইতিহাসে সবপ্রথম এটি একটি লিখিত সনদ। মহানবীর সাল্লাহু সালাম এর মদিনায়
মদিনা সনদ: মহানবি সাঃ ৬২২ খ্রীঃ মক্কা হতে মদিনায় হিজরত করার পর মদিনায় ইসলামের নিরাপত্তার বিধান, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, সুশাসন কায়েম ও বিবাদ মান মদিনাবাসিদের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে তিনি সকল গোত্রের নেতাদের সাথে বৈঠক করে একটি লিখিত সনদ প্রণয়ন করেন।
বিশ্বের ইতিহাসে এটা প্রথম একটি লিখিত সংবিধান
ঐতিহাসিক পিটি হিস্ট্রি বলেন, এর আগে কোনো শাসক, কোনো রাজা এধরনের সংবিধান তৈরি করেনি।
এ সনদে সরকারের প্রকৃতি ও নাগরিকের অধীকারে ও ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে বলে এটা ম্যাগনাকাটা ও বলা হয়েছে।
এই সনদের মোট 47 টি ধারা ছিল।
মানবাধিকারঃ-
মানবসভ্যতার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য এবং একজন মানুষের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা যে অধিকার তাই মানবাধিকার।
মানব সভ্যতার তিনটি উপায়
জিবন
স্বাধীনতা
নিরাপত্তা
মহানবী সাঃ বিভিন্ন উদ্দেশ্য এই সনদ প্রনয়ন করেন প্রফেসর লা মার্টিন তার ‘তুরস্কের ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘কার এমন ধৃষ্টতা আছে যে, ইতিহাসের অন্য কোনো মহামানবের সাথে হজরত মোহাম্মদ সা:-এর তুলনা করতে পারে?
পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ বলে পরিচিত বিভিন্ন মনীষী জীবনের কোনো একটা ‘বিশেষ দিক’ নিয়ে লড়াই করেছেন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু মহানবী সা:-এর ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও ব্যতিক্রম। তিনি ব্যক্তিজীবন থেকে জাতীয় জীবন পর্যন্ত মানবমুক্তির ‘মাইলফলক’ হয়ে আছেন।
তৎকালীন ঘুণেধরা, ভঙ্গুর, অগ্নিগহ্বরে পতিত সমাজ থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়ার জন্য তিনি যেভাবে চাইতেন, বা তাঁর হৃদয় যেভাবে নাড়া দিত অথবা ব্যাকুল করে তুলত ঠিক সেভাবেই তিনি তাঁর বীজ স্বয়ং নিজ হাতে বপন করে তাতে পানি ঢেলে নিরলস পরিচর্যা করে অবশেষে তা মহীরুহে পরিণত করে তুলেন। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর এ অনুপম কার্যক্রম শুধু একদেশ, এক জাতি তথা নির্দিষ্ট কোনো ভাষাভাষীদের জন্য নয় বরং সমগ্র দুনিয়াবাসীর জন্যই ছিল এক চিরভাস্বর, চিরমূর্ত, সর্বজনীন শাশ্বত বিধান।
মানবতার মৃত্যুকালীন সে লগ্নে প্রয়োজনীয় সমস্ত উপাদান, উপাচার স্বয়ং সেই সেনাপতিকেই সংগ্রহ করে নিতে হয়েছিল নিজ দায়িত্বে। আর এসবই সম্ভব হয়েছিল মূলত দুটি কারণে।
১. আল্লাহর শাশ্বত বাণী আল কুরআনের নির্দেশিকা
২. মহানবী সা:-এর অনুপম শ্রেষ্ঠ চরিত্র ও আদর্শ নীতিমালা।
‘হে মুহাম্মদ (সা:) তুমি এখন সেই দ্বীনের দাওয়াত দাও যার হুকুম তোমাকে দেয়া হয়েছে এবং তার ওপর মজবুতির সাথে দাঁড়িয়ে থাকো। কিন্তু এই লোকদের ইচ্ছা-বাসনা অনুসরণ করো না। তাদেরকে বলো, আল্লাহ যে কিতাব নাজিল করেছেন আমি তার প্রতি ঈমান এনেছি। আমাকে হুকুম দেয়া হয়েছে যে, আমি তোমাদের প্রতি ন্যায়বিচার করব।’ (সূরা আশ শুরা-১৫)
এভাবেই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আল্লাহ তাঁর বান্দাকে জগদ্বাসীর মুক্তির দূত হিসেবে গড়ে তুলতে এবং ধ্বংসন্মুখ মানবজাতিকে অগ্নিকুণ্ডের কিনার থেকে তুলে আনতে স্বয়ং নিজেই তাঁর প্রেরিত সেনাপতির পক্ষে সার্টিফিকেট দেন’ লাক্কাদ কানা লাকুম ফি রাসূলিল্লাহি উছওয়াতুন হাছানা।’ (সূরা আহজাব-২১)
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অনুপম চরিত্র ও আদর্শের মূর্ত প্রতীক মহানবী সা:-এর মিশন তাঁর ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই পরিলক্ষিত এবং জীবনের শেষদিন অবধি কার্যকর ছিল।
যেমন-ঃ
১. তিনি তাঁর দুধমাতার একটিমাত্র স্তন্যপান করতেন দুগ্ধপায়ী দুধভাইয়ের অধিকার রক্ষার্থে।
২. মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই বালক বয়সেই এই মহামানব দৃপ্ত পদচারণায় স্বাক্ষর রেখেছেন তৎকালীন একটি অন্যায় অসম চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের বিরুদ্ধে। যা ফুজারের যুদ্ধ নামে খ্যাত।
৩. কিশোর বয়সেই মানবের মুক্তির লক্ষ্যে তিনি হিলফুল ফুজুল নামে একটি শান্তি সঙ্ঘে যোগ দিয়ে গৃহীত কর্মসূচিকে গতিশীল করে তোলেন।
৪. পাওনাদারের অধিকার আদায়ে সোচ্চার যুবক নবী তৎকালে মক্কার প্রভাবশালী ব্যক্তি আস ইবনে ওয়ায়েলের মতো একগুঁয়ে ব্যক্তিকেও বাধ্য করেছেন জোবায়েদ বংশের জনৈক ব্যক্তির মালের মূল্য যথাযথভাবে পরিশোধ করতে।
৫. সমতার ভিত্তিতে হজরে আসওয়াদকে কাবাগৃহের যথাস্থানে স্থাপন করে ভ্রাতৃত্ববন্ধনের এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি।
৬. শুধু মানবতার মুক্তির লক্ষ্যেই তিনি বিত্তবৈভব, দুনিয়ার ভোগবিলাস ত্যাগ করে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন হন।
👉 এভাবে নবুওয়াতের আগেই তিনি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এক ব্রতী জীবন গ্রহণ করেন আর পরবর্তীতে নবুওয়াত প্রাপ্তির পর মাত্র ২৩ বছরে তিনি সমাজের প্রতিটা স্তরে মুক্তি ও শান্তির ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিশ্ব ইতিহাসে জাজ্ব¡ল্যমান হয়ে ওঠেন।
এ কারণেই মনীষী বার্নার্ড শ’ বলেছেন

I believe that if a man like prophet Muhammad was to assume the dictatorship of modern world would success in solving its problem in a way that wold being in men needed peace and happiness.

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় নবুওয়াতের পরবর্তী কার্যক্রম
১. রাসূল সা:-এর জীবনের কোনো যুদ্ধই আক্রমণাত্মক ছিল না। ঐতিহাসিকদের মতে, নবীজি স্বয়ং ২৭টি প্রতিরোধমূলক যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সাহাবিদের নেতৃত্বে ৫৭টি অভিযান পরিচালনা করেন। ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের পর মহানবী সা: বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানের সাথে সংলাপ, সমঝোতা করে অসংখ্য চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করেন যা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার মাইলফলক।
২. মুহাম্মদ সা: এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন যেখানে জাকাতভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করায় মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের গ্যারান্টি ছিল।
৩. আল কুরআনভিত্তিক সমাজ গঠনের ফলে সে সময়ে এমন একটি সুস্থির পরিবেশ গড়ে উঠল যা পরবর্তী আড়াই বছর অর্থাৎ হজরত আবু বকর রা:-এর শাসনামলেও আদালতে অপরাধের কোনো অভিযোগ দায়ের হয়নি।
৪. মানবসভ্যতার প্রসূতিকাগার, সমাজ গঠনের অন্যতম কারিগর ‘নারী’ জাতির মুক্তি সাধন, সম্মান প্রতিষ্ঠায়ও তিনি অনন্য অবদান রেখে যান যা পরবর্তী পৃথিবীর জন্য এক অনুপম নিদর্শন।
৫. শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। এ শিক্ষার জন্যও সংগ্রামকারী রাসূল সা: দোয়া করেছেন ‘হে আল্লাহ! যে জ্ঞান উপকারে আসে না তা থেকে আপনার কাছে পানাহ চাই।’
ইতিহাস থেকে জানা যায়, শিক্ষার মুক্ত পরিবেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য জ্ঞানার্জন ফরজ হুকুম বলে ঘোষণা দেন। এমনকি বদর যুদ্ধে বন্দী কয়েদিদের মুক্তিপণ হিসেবে তাদেরকে মদিনাবাসীর শিক্ষাদানে আহ্বান জানান।
৬. মদিনায় হিজরতের পর মহানবী সা: সেখানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর নিরাপত্তা ও কল্যাণের স্বার্থে প্রধান যে উদ্যোগটি নেন তা বিশ্বখ্যাত ‘মদিনা সনদ’ নামে প্রতিষ্ঠিত।
👉 দূরদর্শী নবীজি প্রত্যক্ষ করেন মদিনার সামাজিক জীবনের গতিধারা বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত। এদেরকে একত্র করতে না পারলে আল্লাহর শাশ্বত বিধান প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। উপরন্তু মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াসী নবীজি চিন্তা করলেন মানুষ বেঁচে থাকুক-নিজেদের বুদ্ধির কষ্টিপাথরেই তারা শুদ্ধ ও সঠিক ধর্ম যাচাই করুক, তারপর স্বেচ্ছায় ধর্মগ্রহণ করে শান্তির পতাকাবাহী হোক। তিনি উপলব্ধি করলেন, ধর্ম পালনে নেই কোনো জবরদস্তি। আল্লাহর ভাষায় ‘লা ইকরাহা ফিদ্দিন’ এই গাইড লাইন সামনে রেখে তিনি সব গোত্রকে ভিন্ন ভিন্ন মর্যাদা দিয়ে মদিনা সনদ রচনা করেন এবং সবাইকে এক রাষ্ট্রভুক্ত করার প্রয়াস পান।
‘মদিনা সনদ’ মূলত একটি চুক্তি। এই চুক্তি উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, গোত্রীয় দম্ভ, ধর্মবিদ্বেষ, অঞ্চলপ্রীতি, দেব-দেবীর নামে কর্তৃত্ব মূলত মানবতার শত্রু ও প্রগতির অন্তরায় সব রকম প্রয়াস খতম করে সাফল্যের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণ ও দায়িত্ব কর্তব্যের বিবরণ সংবলিত এক অনন্য দলিল। এই দলিল পর্যালোচনা করলে মহানবী সা:-এর মানবাধিকার ঘোষণার প্রকৃষ্ট পরিচয় প্রতিভাত।
বলা যায় এই মদিনা সনদের ধারাবাহিকতা ধরেই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় পরবর্তী যুগে যথাক্রমে ১২১৫ সালের ম্যাগনা কার্টা, ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইট, ১৬৭৯ সালের হেবিয়াস কার্পাস অ্যাক্ট, ১৬৮৯ সালের বিল অব রাইটস এবং ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক ঘোষিত ‘সর্বজনীন মানবাধিকার’ ঘোষিত হয়। ঐতিহাসিক ‘গিবন’ বলেন In the long history
মদিনা সনদের মূল বক্তব্য ছিল
ক. মদিনাবাসী তথা ইহুদি, মুশরিক, মুসলিম সবাই সমমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক।
খ. প্রত্যেকেরই ধর্মানুসরণে নিজ নিজ স্বাধীনতা থাকবে।
গ. একের বিরুদ্ধে অপরের ষড়যন্ত্র আঁটা যাবে না।
ঘ. রাসূল সা:-এর বিনা অনুমতিতে কেউ কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে না।
ঙ. মদিনা শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে একে রক্ষা করার দায়িত্ব সবার।
চ. এই সনদ ভঙ্গকারীকে মদিনার দুশমন বলে ধরে নেয়া হবে।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এই দলিলকে ‘মন্টোগোমারি ওয়াট’ তার মুহাম্মদ এট মদিনা গ্রন্থে বলেছেন The Constitution of Madina’ অর্থাৎ মদিনার সংবিধান।
এই ঐতিহাসিক চুক্তিতে মদিনার কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা উল্লেখ করা হয়নি বরং উল্লেøখ করা হয় বিভিন্ন পরিচয়ের জনগোষ্ঠীকে এবং ভবিষ্যতে যেসব মুসলিম হিজরত করে মদিনায় আসবে তারাও এর অন্তর্ভুক্ত হবে ফলে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এই সনদ হয়ে ওঠে যুগান্তকারী।
৭. মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী সা:-এর আরো একটি কীর্তি হচ্ছে হুদায়বিয়ার সন্ধি। আপাতদৃৃষ্টিতে নতজানু সন্ধি মনে করে প্রিয় সাহাবিরা মনস্তাত্ত্বি¡ক কারণেই মর্মাহত হয়ে পড়েন কিন্তু মহান আল্লাহ স্বয়ং একে ‘সুস্পষ্ট বিজয়’ বলে অভিহিত করেন।
ঐতিহাসিকদের মতে এ ধরনের একটি আপসচুক্তি ছিল অত্যন্ত বিরল ঘটনা। যে কুরাইশরা এত্তগুলো মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত করেছে, যারা মুসলিমদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, যারা তখনো তাদেরকে হারাম শরিফে ঢুকতে দেয়নি এবং বহন করে আনা কোরবানির জন্তুগুলোকেও ফিরিয়ে দিচ্ছিল এ হেন কপট, যুদ্ধবাজ আগ্রাসী মুশরিকদের এমন আকস্মিকভাবে সন্ধি ও সমঝোতায় নিয়ে আসা নবীজি সা:-এর জন্য একটি প্রাথমিক বিজয় ছিল যা পরবর্তীতে আরো বৃহত্তর বিজয় ডেকে নিয়ে আসে। দূরদর্শী মহামানব এই সন্ধিপত্রে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও বৃহত্তম স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্রতম স্বার্থের বিসর্জন হিসেবে মেনে নিয়ে এক চরম রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি থেকে মানবতাকে রক্ষা করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মদিনায় ফিরে যাওয়ার পথেই চূড়ান্ত বিজয়ের ঘোষণা দিয়ে দেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিশ্চয়ই আমরা তোমাকে বিজয় দিয়েছি এক সুস্পষ্ট বিজয়।’ (সূরা ফাতহ-১)
৮. মহানবী সা:-এর মক্কা বিজয়ের ঘটনাতেও মানবাধিকারের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নিহিত। বিজয় মানুষকে আত্মহারা করে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য করে দেয়, প্রতিশোধ স্পৃহায় দাউ দাউ আগুনে হৃদয়হীন করে দেয় কিন্তু ক্ষমার মূর্তপ্রতীক মহানুভবতায় উদ্ভাসিত মহানবী সা: মানবের জানমালের নিরাপত্তায় ‘মক্কা বিজয়ে’ এক অতন্দ্র প্রহরীর দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যান।
ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক বলেছেন, আমি বিশ্বস্ত লোকদের কাছে শুনেছি, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল সা: কাবার দরজায় দাঁড়িয়ে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন ‘হে কুরাইশ! জেনে নাও তোমাদের জাহেলিয়াতের আভিজাত্য এবং পূর্বপুরুষদের নামে বড়াই করার প্রথা আল্লাহ রহিত করে দিয়েছেন। সমস্ত মানুষ আদমের সন্তান এবং আদম মাটির তৈরি।’
অতঃপর রাসূল সা: সূরা হুজুুরাত থেকে তেলাওয়াত করেন ‘হে মানুষ! আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে। তারপর তোমাদেরে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি এবং গোত্রে যাতে করে তোমরা পরস্পরের সাথে পরিচিত হতে পারো। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাবান-যে অধিক খোদাভীরু। অবশ্যই তিনি জ্ঞানী এবং সর্বজ্ঞাতা। (১৩)
সময় মানবতার প্রতিষ্ঠাতা নবীজি জালিম কুরাইশদের কাছ থেকে নিজের সমুন্নত চরিত্রমাহাত্ম্য এর স্বীকৃতিও আদায় করে নেন ক্ষমা ও মহানুভবতা দিয়ে।
৯. বিদায় হজের ভাষণটিও মহানবী সা:-এর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আরো একটি অনুপম দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রণিধানযোগ্য। জীবনের শেষ সময়ে শেষ ভাষণেও তিনি মানবতার মুক্তির পেরেশানিতেই নিমজ্জিত ছিলেন। তাঁর মূল্যবান সেই ভাষণের কিছু বিশেষ দিক হচ্ছে যথা
ক. জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা; খ. আমানতের নিরাপত্তা; গ, সুদের কারবার নিষিদ্ধ ঘোষণাসহ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা; ঘ. কুসংস্কার রহিতকরণ; ঙ. খুনের প্রতিশোধমূলক যুদ্ধ রহিত; চ. জাহেলি পদ-পদবি ও মর্যাদা রহিত; ছ. হত্যার ন্যায়সঙ্গত শাস্তিবিধান; জ. স্বামী-স্ত্রীর অধিকার সংরক্ষণ; ঝ. একের দণ্ড অন্যকে বহন রহিত; ঞ. খোদাভীরুতার মানদণ্ডে নেতৃত্ব ও আনুগত্য প্রতিষ্ঠা সে দেখতে যেমনই হোক; ট. মুসলিমদের পারস্পরিক সম্পর্ক হবে ভ্রাতৃত্ববোধের; ঠ. সমাজের প্রতিটি স্তরে ঐক্য ও সাম্যতার ভিত্তিতে বিশ্বমানবতা বোধ; ড. অধীনস্থদের অধিকার নির্ধারণ; ঢ. পিতৃত্ব অস্বীকার নিষিদ্ধ ঘোষণা; ণ. ব্যভিচারীর দণ্ড প্রদান; ত. উত্তরাধিকার নির্ধারণ; থ. দান-ঋণ-আমানত রক্ষা; দ. দ্বীনের যথাযথ হিফাজত; ধ. মর্যাদার সিঁড়ি তাকওয়া; ন. জবাবদিহিতামূলক জিন্দেগি ইত্যাদি।
এভাবে তিনি আরো অনেক বিষয়ের দিকনির্দেশনা দিয়ে উপস্থিত জনতার কাছ থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ করেন মানবজাতির মুক্তির লক্ষ্যে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেয়ার স্বীকৃতি। অবশেষে তিনি আল্লøাহর পক্ষ থেকে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় একমাত্র বিধান ইসলামের চরমপত্র ঘোষণা দেনÑ ‘আজ আমি তোমাদের জন্য পূর্ণ করে দিলাম তোমাদের দ্বীনকে। পরিপূর্ণ করে দিলাম তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত (আল কুরআন) এবং তোমাদের জন্য দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) মনোনীত করলাম ইসলামকে।’ (সূরা মায়েদা-৩)
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাকারী এই মহামানব রাসূল সা: নিজে আরবি হয়েও ঘোষণা করেন ‘অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ (আল হাদিস) Simon Ockly রচিত ‘History of the Saracens’ গ্রন্থে বলেছেন মহানবী সা: তরবারির মাধ্যমে ধর্ম প্রচার করেননি, যা বিশ্বে তাকে শান্তির দূত হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাকারী এই মহামানব সম্পর্কে পবিত্র কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন ‘আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তাহলে আমার অনুসরণ করো। আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহ মাফ করবেন। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়।’ (সূরা আলে ইমরান-৩১)

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১
১৩১৫১৬১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭৩০