সারাদেশ

পুলিশের ভয়ে বেশির ভাগ স্বজনই মামলা করেন না!!!

নাঈমা আক্তার পুস্প ::

পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বজনরা মামলা করেন না। কারণ, মামলা করার পর দেওয়া হয় হুমকি ধমকি, আপনজনের বিরুদ্ধেও মামলা হয়, শুধু তাই নয়, যারা সহযোগিতা করে-তাঁদের বিরুদ্ধেও মামলা-হামলা হয়। নানাভাবে ভীতি প্রদর্শনেরও অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে পুলিশের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো আইনি-সহায়তা না চেয়ে নীরব থাকে। যেমনটি হচ্ছে নাছির উদ্দিনের পরিবারের স্বজনদের ক্ষেত্রে।

এমন বাস্তবতায় বুধবার ২০১৩ সালের নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে কোনো মামলায় দেশে প্রথম রায় ঘোষণা হলো। ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ইশতিয়াক হোসেন জনি নামে এক জনকে বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ধরে পল্লবী থানায় নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ; যা এ আইনে সর্বোচ্চ সাজা।

পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন বা মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের চাকরিচ্যুতি, পদোন্নতি স্থগিত ও পদাবনতির মতো শাস্তি দেওয়া হয়।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সারা দেশে পুলিশের হেফাজতে ১৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে গ্রেফতারের পূর্বে নির্যাতনে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। গ্রেফতারের পর শারীরিক নির্যাতনে সাত জনের মৃত্যু হয়েছে। থানার হাজতখানায় এক জন আত্মহত্যা করে। বাকি তিন জন নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যায়।

নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ অনুযায়ী কেউ নির্যাতনের শিকার হলে আদালতে অভিযোগ করতে পারে। শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন প্রমাণিত হলে শাস্তি হিসেবে ন্যূনতম ৫ বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এছাড়া নির্যাতনের ফলে মৃত্যু হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড হতে পারে।

গত ১৬ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ গাড়িচালক আলমগীর হোসেনকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যায়। ওই দিন রাতে থানায় রেখে রাতভর মারধর করা হয়। থানা থেকে মুক্তি পেতে তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। পরে তার কাছ থেকে ৮০ পিস ইয়াবা উদ্ধার দেখিয়ে মাদক আইনে একটি মামলা দায়ের করে। আদালতে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর সময় তিনি পড়ে যান। তার দুই পায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল। কারাগারে আলমগীর অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৯ ডিসেম্বর তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিত্সকরা মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় গত ১৬ জানুয়ারি ঢাকার আদালতে নিহতের স্ত্রী আলেয়া বেগম বাদী হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা, এসআই মো. মিজানুর রহমান, এএসআই নামজুল ও মো. সোহাগকে আসামি করে একটি মামলা করেন। মামলার বাদী অভিযোগ করেন, পুলিশের বিরুদ্ধে মামলার পর থেকে অজ্ঞাত মোবাইল ফোন নম্বর থেকে মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, মামলা তুলে না নিলে, তার পরিণতি স্বামীর মতোই হবে।

গত ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার হাজতে আবু বক্কর সিদ্দিক বাবু (৩৫) নামে একজন আসামি মারা যান। পুলিশ বলছে, ওই আসামি হাজতের গ্রিলের সঙ্গে চাদর পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তবে গ্রিলের সঙ্গে চাদর পেঁচিয়ে আত্মহত্যার বিষয়টি মানতে রাজি নন নিহত বাবুর সহকর্মীরা। বাবু বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) ফ্লোর ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে একজন নারী ডিজিটাল নিরাপত্তা ও নারী নির্যাতন আইনে মামলা করেছিলেন। ওই মামলাতেই গত ১৮ জানুয়ারি রাতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বাবুর মৃত্যুর ঘটনার বিচার চেয়ে এফডিসির সহকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন। ঘটনাটি তদন্তে পুলিশের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, হেফাজতে মৃত্যু নানা কারণে হতে পারে। নির্যাতনের অভিযোগ যেমন উঠে আসে, তেমনি অসুস্থতার কারণে মৃত্যুর উদাহরণও রয়েছে। হেফাজতে আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে কখনো কখনো। পুলিশি হেফাজতে যে কারণেই মৃত্যু ঘটুক না কেন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা পুলিশ সদস্যদের কোনো গাফিলতি, বিচ্যুতি বা অপরাধ প্রমাণিত হলে তার বা তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই উপযুক্ত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হ?বে।

২০১৪ সালের ১২ জুলাই রাতে রাজধানীর ধানমন্ডির শঙ্কর এলাকার বাসা থেকে ঝুট ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান সুজন, তার স্ত্রী মমতাজ সুলতানা লুসি, সন্তান মোশারফকে এসআই জাহিদুর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম আটক করে মিরপুর থানায় নেয়। থানার একটি কক্ষে সুজনকে আটকে রেখে বেধড়ক পেটানো হয়। এরপর ভোরে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিত্সক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় ২০ জুলাই নিহতের স্ত্রী মমতাজ সুলতানা লুসি আদালতে একটি হত্যা মামলার অভিযোগ করেন। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ এর ১৫(১)(২)(৩)(৪) ধারায় মালাটি করা হয়। মামলায় আট জনকে আসামি করা হয়। মামলাটি আদালতে বিচারাধীন।

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭৩০