শীর্ষ সংবাদ

ক্যামেরুনের টানা আট বারের প্রেসিডেন্ট বিয়া, বয়স ৯২, হারেননি কোনো নির্বাচনে

ক্যামেরুনের সাংবিধানিক পরিষদ ৯২ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট পল বিয়া’কে টানা অষ্টমবারের মতো নির্বাচিত ঘোষণা করেছে। কে কী বললো তাতে কিছু এসে যায় না। এর মধ্য দিয়ে তিনি হলেন বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক রাষ্ট্রপ্রধান। এ খবর দিয়ে অনলাইন বিবিসি বলছে, ফল ঘোষণার আগে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। শোনা যাচ্ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতা নাকি হাড্ডাহাড্ডি হবে। এমনকি বিরোধী প্রার্থী ও সাবেক মন্ত্রী ইসা চিরোমা বাকারি নিজের জয়ের দাবিও করেছিলেন। কিন্তু সোমবার যখন ফলাফল প্রকাশিত হয়, দেখা যায় বিয়া পেয়েছেন ৫৩.৭ ভাগ ভোট। আর বাকারি পেয়েছেন ৩৫.২ ভাগ। অনেক ক্যামেরুনবাসীর জন্য এটি যেমন এক ধাক্কা, তেমনই আবার প্রত্যাশিতও ছিল। ৪৩ বছর ধরে ক্ষমতায়  আছেন প্রেসিডেন্ট বিয়া। এর পরও বিয়ার আরও সাত বছরের জন্য প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত স্বভাবতই বিতর্কিত ছিল। শুধু তার দীর্ঘকালীন শাসন নয়, তার শাসনপদ্ধতিও নানা প্রশ্ন তুলেছে।

mzamin

প্রায়ই তাকে দেশের বাইরে, বিশেষ করে জেনেভার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল বা সুইজারল্যান্ডের হ্রদপাড়ের অন্য কোনো গোপন স্থানে থাকতে দেখা যায়। এতে অনেকেই সন্দেহ করেন, তিনি আদৌ ক্যামেরুন শাসন করছেন কি না, নাকি আসলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যরা বা প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের শক্তিশালী সচিব জেনারেল ফার্দিনান্দ এনগোহ এনগোহ। গত বছর আগস্টে ফ্রান্সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ স্মরণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এবং পরের মাসে বেইজিংয়ে চীন-আফ্রিকা সম্মেলনে যোগ দেয়ার পর প্রায় ছয় সপ্তাহ তিনি জনসমক্ষে আসেননি। এতে তার স্বাস্থ্য নিয়ে নানা জল্পনা তৈরি হয়। অবশেষে যখন ঘোষণা আসে যে তিনি রাজধানী ইয়াউন্ডেতে ফিরছেন, তখনই তার উপস্থিতি নিশ্চিত হয়। তবুও এ বছর নির্বাচনের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে আবারও জেনেভায় তার সফর কারও কাছে অবাক হওয়ার বিষয় ছিল না।

বিয়ার নেতৃত্বের ধরন রহস্যময়। তিনি সচরাচর মন্ত্রিসভার পূর্ণ বৈঠক ডাকেন না, জনসম্মুখে জটিল ইস্যু নিয়ে কথা বলেন না। ফলে প্রশাসনের লক্ষ্য ও নীতিনির্ধারণ নিয়ে সবসময় ধোঁয়াশা থেকে যায়। দক্ষ মন্ত্রী ও কর্মকর্তা পর্যায়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক উদ্যোগ ও কর্মসূচি থাকলেও রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা অনুপস্থিত। সরকার মাঝে মাঝে প্রতিবাদ দমন করে বা সমালোচকদের গ্রেপ্তার করে শক্তি প্রদর্শন করেছে। কিন্তু সেটিই তার ক্ষমতায় টিকে থাকার একমাত্র কারণ নয়। বিয়ার একটি রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী ভূমিকা আছে। বৈচিত্র্যময় সমাজ, আঞ্চলিক বৈষম্য এবং ভাষাগত বিভাজনে গঠিত দেশ ক্যামেরুনে- যেখানে দক্ষিণের বিষুবীয় অঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের সাভানা অঞ্চলের মধ্যে পার্থক্য গভীর, আবার ফরাসি ও ইংরেজি ভাষাভাষী অঞ্চলগুলোর শিক্ষা ও প্রশাসনিক ঐতিহ্যও আলাদা- সেখানে তিনি বিভিন্ন পটভূমির প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠন করেছেন।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ ও বৈদেশিক ঋণদাতাদের চাপের মধ্যেও তার সরকার ঋণসংকট এড়াতে পেরেছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল করেছে। গত এক দশকে বিয়াকে অনেকে প্রায় এক ধরনের সাংবিধানিক রাজা হিসেবে দেখছেন- প্রতীকী এক নেতা, যিনি কেবল কিছু মূল বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেন, বাকিগুলো মন্ত্রীরা সামলে নেন। তাকে ঘিরে শাসকদল ক্যামেরুন পিপলস ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (সিপিডিএম)-এর শীর্ষ পর্যায়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। বিয়া থাকায় উত্তরসূরি নির্ধারণের বিষয়টি এখনো ঝুলে আছে। কিন্তু কোনো মনোনীত উত্তরসূরি না থাকায়, এবং পরবর্তী প্রজন্মের নেতারাও এখন বয়স্ক হয়ে পড়ায়, উত্তরাধিকারের প্রশ্নে গুঞ্জন ক্রমেই বাড়ছে। তার পুত্র ফ্রাঙ্ক বিয়ার নামও শোনা যাচ্ছে, যদিও তিনি রাজনীতিতে তেমন আগ্রহী নন।

এদিকে ক্যামেরুনের প্রাকৃতিক সম্পদে বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও উন্নয়ন ও নিরাপত্তা দুই দিকেই চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। তাহলে কি এখন ক্যামেরুনবাসীরা বিয়ার দীর্ঘায়িত আধা-স্বৈরশাসনের প্রতি সহনশীলতা হারাচ্ছে? বহুদলীয় নির্বাচনের সুযোগ থাকলেও যদি শাসক পরিবর্তনের বাস্তব সম্ভাবনা না থাকে, মানুষ কি এ ব্যবস্থায় ক্লান্ত হয়ে পড়ছে? ইংরেজিভাষী অঞ্চলের রক্তক্ষয়ী সংকট কি তার সাবধানী ও দূরত্ব-রক্ষাকারী রাজনীতির সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে দিয়েছে? ২০১৬ সালে যখন সেখানে সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়, বিয়ার প্রতিক্রিয়া দিতে দেরি করেন। পরবর্তীতে যখন তিনি সংলাপ ও পরিবর্তনের প্রস্তাব দেন, ততদিনে সহিংসতা এতটা বেড়ে গিয়েছিল যে আপসের জায়গা হারিয়ে যায়। তার নেতৃত্বে কোনো স্পষ্ট অর্থনৈতিক বা সামাজিক উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গিও দেখা যায় না, যা জনগণকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। ২০১৮ সালে সপ্তম মেয়াদে প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্তেই জনগণের ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছিলেন তিনি। তবুও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী মরিস কামতোকে পরাজিত করেন এবং কামতো ফলাফল প্রত্যাখ্যান করলে তাকে আট মাসেরও বেশি সময় আটক রাখা হয়।

কিন্তু এবার ইসা চিরোমা বাকারির প্রার্থিতা পরিস্থিতি বদলে দেয়। ১৯৯২ সালের পর এমন উদ্দীপনা আর দেখা যায়নি। তৎকালীন নির্বাচনে সিডিএফ প্রার্থী জন ফ্রুন্দিকে ৩৬ ভাগ ভোট দেয়া হয়েছিল, যেখানে বিয়া পেয়েছিলেন ৪০ ভাগ। এবারের পার্থক্য হলো- বিয়া এখন আরও বিচ্ছিন্ন। আর চিরোমা, একজন মুসলিম উত্তরাঞ্চলীয় রাজনীতিক, তার জনপ্রিয়তা বিস্তৃত করেছে দেশের নানা অঞ্চলে, এমনকি ইংরেজিভাষী এলাকাগুলোতেও। একসময় তিনি রাজনৈতিক বন্দি ছিলেন, পরে বিয়ার সঙ্গে সমঝোতা করে মন্ত্রী হন। নির্বাচনের আগে তিনি ইংরেজিভাষী শহর বামেন্ডায় গিয়ে সরকারের কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষমা চেয়ে সাহসিকতার পরিচয় দেন। ফল ঘোষণার আগে তিনি উত্তরাঞ্চলের গারোয়ায় অবস্থান করেন, যেখানে তরুণ সমর্থকরা তাকে নিরাপত্তা বাহিনীর সম্ভাব্য গ্রেপ্তার থেকে রক্ষা করতে জড়ো হন।

এখন ঘোষিত ফলাফলের পর বিরোধী শিবিরে ক্ষোভ ও হতাশা তীব্র। অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র দৌয়ালায় বিক্ষোভ দমনে সেনারা গুলি চালিয়েছে বলে খবর এসেছে, গারোয়া থেকেও গুলির খবর পাওয়া গেছে। ক্যামেরুনের জন্য বিয়ার অষ্টম মেয়াদ নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা বড় ঝুঁকি ও বেদনাদায়ক মূল্য নিয়ে এসেছে।

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১
১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭৩০৩১