ক্রমেই বাড়তে থাকা রিজার্ভ হঠাৎ করে ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। এতে উদ্বেগ এবং শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও পরিস্থিতি সামাল দিতে এক সপ্তাহে বেশকিছু পদেক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এ থেকে সুফল মিলছে না। ছুটেই চলেছে ডলারের দর। বিপরীতে টাকার মান কমছেই। আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে ডলারের দর অনেক বেড়ে যাওয়ায় গত বৃহস্পতিবারও প্রতি ডলারে আরও ৫০ পয়সা বাড়িয়ে দর ঠিক করা হয়েছে ৯৪ টাকা ৪৫ পয়সা। এ নিয়ে এক বছরে আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলারে বাড়লো ৯ টাকা ৬৫ পয়সা বা ১১.৩৮ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কয়েক মাস ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের মজুতে চাপ পড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্য, কাঁচামাল ও তেলের দাম বেড়ে গেছে।সঙ্গে বেড়েছে জাহাজের ভাড়াও। এতে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে জোগান দিতে হচ্ছে আমদানির খরচ। এর চাপ গিয়ে পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর। কারণ, আমদানি যে হারে বেড়েছে, রপ্তানি সে হারে বাড়েনি। আবার প্রবাসী আয়ও কমে গেছে। ফলে প্রতি মাসে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। আবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপ রয়েছে রিজার্ভের হিসাব সঠিক নিয়মে করার।
এদিকে খেলাপি ঋণ, রিজার্ভ ও ডলার রেট নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাব পদ্ধতি পরিবর্তন আনা ও খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার তাগিদ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। একইসঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ব্যবস্থা বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। এ ছাড়া বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ও চলতি হিসাবে ভারসাম্য উন্নতির বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফ’র শেষ বৈঠকে এসব পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। সংস্থাটির পরামর্শ মানতে গেলে রিজার্ভের অর্থে গঠিত রপ্তানিকারকদের ঋণ তহবিল, সরকারি প্রকল্প ও শ্রীলঙ্কাকে দেয়া ঋণ এবং সোনালী ব্যাংকে রাখা আমানত রিজার্ভের হিসাব থেকে বাদ দিতে হবে। এতে রিজার্ভ কমবে ৭০০ কোটি ডলারের বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বাজারে ডলারের চাহিদা মেটাতে বৃহস্পতিবার কয়েকটি ব্যাংকের কাছে আরও ৭ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ নিয়ে চলতি অর্থবছরের কয়েকদিনে বিক্রি করা হয়েছে ৭০ কোটি ডলার। গত অর্থবছর বিক্রি করা হয় ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার। এর আগের অর্থবছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৭৯৩ কোটি ডলার কিনেছিল। ডলার বিক্রির ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। গত বছরের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করা রিজার্ভ এখন দাঁড়িয়েছে ৩৯.৬০ বিলিয়ন ডলারে। গত বছরের ডিসেম্বরে রিজার্ভের অঙ্ক ছিল ৪৬.১৫ বিলিয়ন ডলার।
জানা গেছে, ডলার সংকটের কারণে বেশকিছু ব্যাংক বড় এলসি খুলতে রাজি হচ্ছে না। আর খুললেও পণ্যের এলসিতে দাম দিতে হচ্ছে বেশি। আমদানি পর্যায়ে ডলারের দাম উঠেছে প্রায় ১০০ থেকে ১০২ টাকায়। অথচ কয়েক মাস আগেও ৮৬ টাকার নিচে ছিল। এ ছাড়া প্রবাসীদের রেমিট্যান্স এবং দেশের রপ্তানিকারকদের ক্ষেত্রে ডলারের দর এখন ১০০ টাকার আশপাশে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাস পর্যন্ত আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৫৪০ কোটি ডলার। একই সময় পর্যন্ত রপ্তানি আয় হয়েছে ৪ হাজার ৪৫৮ কোটি ডলারের। এতে করে প্রথম ১১ মাসে রেকর্ড ৩ হাজার ৮২ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ: ডলারের খরচ কমাতে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় কাটছাঁট করা হয়েছে ও বিদেশ যাওয়ার ওপর কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির খরচ সাশ্রয়ে সপ্তাহে এক দিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখা, এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংসহ বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছে সরকার। আমদানি ব্যয় কমাতে গাড়ি, টিভি, ফ্রিজসহ ২৭ পণ্যে শতভাগ এলসি মার্জিন নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়। একইসঙ্গে বাজারে ডলার সরবরাহ বাড়াতে ব্যাংক ও রপ্তানিকারকের ডলার ধারণের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। রপ্তানি আয় আসার এক দিনের মধ্যে ডলার নগদায়নের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আবার অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে নেয়া ঋণ স্থানীয় মুদ্রায় স্থানান্তরের সুযোগ দেয়া হয়েছে। ইডিএফ থেকে নেয়া ঋণ কেবল রপ্তানিকারকের নিজস্ব আয় বা জমা বৈদেশিক মুদ্রা থেকে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। ইডিএফ’র সুদহার ১ শতাংশ বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে করোনার সময়ে দেয়া শিথিলতার মেয়াদ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মজুত নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। প্রকৃত রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার হতে পারে। তিনি বলেন, রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ডে (ইডিএফ) যা বিনিয়োগ করা হয়েছে তা কেন রিজার্ভ হিসাবে ধরবো? এ ছাড়া রিজার্ভ থেকে শ্রীলঙ্কাকে দেয়া ঋণ ফেরত আসার সম্ভাবনা খুবই কম। সবমিলিয়ে রিজার্ভ সন্তোষজনক অবস্থানে নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে কিন্তু সংকট উত্তরণে কাজ করছে না। তিনি বলেন, আমদানির ওপর শক্ত নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে। বিলাসী পণ্য আমদানি করাই যাবে না। তা না হলে রিজার্ভ সংকট উত্তরণ সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার যোগদান করে গণমাধ্যমকে বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এমন একটা অবস্থানে নিয়ে যেতে চাই, যেন ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারি।
রিজার্ভ হিসাবায়ন পদ্ধতি: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবায়নে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর পরামর্শ বাংলাদেশ ব্যাংক মানবে না বলে জানা গেছে। এখন যেভাবে এর হিসাবায়ন হচ্ছে, ভবিষ্যতেও একইভাবে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এর আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে একাধিকবার পরামর্শ দিয়েছিল আইএমএফ। সর্বশেষ গত ১৭ই জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকেও পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দেয়া হয়। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার পরামর্শের পাশাপাশি ব্যাংকের আমানত ও ঋণের সুদহারের ওপর যে সীমা রয়েছে, তা তুলে দেয়ার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। আইএমএফ স্টাফ ভিজিট মিশন-২০২২ নামে প্রতিনিধিদলটি গত বৃহস্পতিবার ঢাকা সফরে এসেছে।
সংস্থাটি বলেছে, রিজার্ভের অর্থে গঠিত ইডিএফসহ বিভিন্ন ঋণ তহবিল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যা এখনও রিজার্ভেই দেখানো হচ্ছে। অথচ এগুলো নন লিক্যুইড সম্পদ বা ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড সিকিউরিটিজ। সংস্থাটির ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম-৬) ম্যানুয়াল অনুযায়ী, এসব দায় রিজার্ভ হিসেবে বিবেচিত হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবায়নে আইএমএফ’র এ পরামর্শ মানবে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, আগের ধারাবাহিকতায় গত সপ্তাহের বৈঠকেও আইএমএফ রিজার্ভের হিসাবায়ন বদলাতে বলেছে। কিন্তু আমরা বলেছি, এতদিন যেভাবে হয়েছে, সেভাবেই হবে। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফকে অ্যাসেট বলতে রাজি নয় আইএমএফ। আমরা বলছি, এটা ফরেন অ্যাসেট। তিনি বলেন, তারা (আইএমএফ) অনেক কিছুই বলতে পারে। আমরা মানতে বাধ্য নই। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের হিসাবায়ন নিয়ে আইএমএফ দ্বিমত পোষণ করতে পারে। কিন্তু কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। এটা নিয়ে (হিসাবায়ন) আমরা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গেও বসবো।
উল্লেখ্য, এর আগে গত বছরের ৩ থেকে ১৪ই অক্টোবর আইএমএফ’র একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসে। সফরের পর সংস্থাটির পক্ষ থেকে একটি ‘সেফগার্ড অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট’ বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়। সেখানে রিজার্ভ হিসাবায়নে বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তারতম্য উল্লেখ করে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে তা নিরসন করার সুপারিশ করা হয়। এরপর গত বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সংস্থাটিকে চিঠি দিয়ে প্রাথমিকভাবে রিজার্ভের হিসাবায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন না আনার সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
সাধারণত, বাংলাদেশ ব্যাংক দুটি পদ্ধতিতে রিজার্ভ হিসাব করে। একটি গ্রস, আরেকটি নিট হিসাব। নিট হিসাবে রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন ঋণ তহবিল বাদ দেয়া হয়। জানা গেছে, আইএমএফ’র হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করলে দেশের রিজার্ভ প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার কমে ৩১ বিলিয়ন ডলারে নামবে। বর্তমানে রিজার্ভের অর্থে ইডিএফে ৭০০ কোটি, জিটিএফে ২০ কোটি, এলটিএফএফে ৩ কোটি ৮৫ লাখ এবং সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে ৬৪ কোটি ডলার ও বাংলাদেশ বিমানকে ৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার ঋণ দেয়া হয়েছে। এই ৭৯২ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের বাইরে কারেন্সি সোয়াপের আওতায় শ্রীলঙ্কাকে দেয়া হয়েছে ২০ কোটি ডলার। এগুলো রিজার্ভ থেকে বাদ দিলে প্রকৃত রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।
যেভাবে রিজার্ভের হিসাব করি, সেভাবেই করবো: অর্থমন্ত্রী
এদিকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে সপ্তাহব্যাপী বৈঠকে ঢাকা সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) স্টাফ মিশনের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের সার্বিক আর্থিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছে। ভর্তুকি কমানো, খেলাপি ঋণ কমানো, ব্যাংক খাতে সুশাসন, রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি ঠিক করা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয় সক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি ছিল প্রধান আলোচ্য বিষয়। সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে গত বৃহস্পতিবার দলটির সঙ্গে বৈঠক ছিল আ হ ম মুস্তফা কামালের। বৈঠকে এসব বিষয় উঠে আসে।
এর আগে গত বুধবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইএমএফ’র মধ্যে মতপার্থক্য সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা যেভাবে রিজার্ভের হিসাব করি, সেভাবেই করবো।
Add Comment