প্রশ্নটি সরাসরিই করা যেতে পারে। কি করছেন আইন,বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ? কি নিয়ে সময় গুজরান করছেন ? কি চাইছেন তিনি ? কাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন আসিফ নজরুল ? রক্তক্ষয়ী ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর দু’মাস হতে চললো। এর মধ্যে কী করেছেন তিনি ? নিজ ‘পছন্দসই’ প্রধান বিচারপতি নিয়োগ। অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নিয়োগ। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ। হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার বলতে এক নম্বরে প্রথম আলোর নারী সাংবাদিক ‘রোজিনা ইসলাম’দের মামলা প্রত্যাহার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩ সংশোধনীর লক্ষ্যে মতবিনিময় সভা। বিভিন্ন এনজিও’র কয়েকটি সভা- সেমিনারে যোগদান। ফিরিস্তি টানলে হয়তো বেরুবে আসিফ নজরুলের এমন ‘অনেক কাজ’। যা তার কাছে বিবেচিত হতে পারে ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিক’, ‘প্রধান’ এবং ‘মূল কাজ’ বলে। কিন্তু জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশের ছাত্র-জনতা অকাতরে যে জীবন দিলেন, তা কি আসিফ নজরুলের এসব কাজের জন্য ?
বলাবাহুল্য, আসিফ নজরুল শেখ হাসিনার মনগড়া সংবিধান সুরক্ষার শপথই নিয়েছেন। ফাইনালি তিনি শেখ হাসিনার সংবিধান তথা হাসিনাকে সুরক্ষা প্রদানের কাজটি নিখুঁতভাবে সম্পাদন করলেও হয়তো বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। কারণ, এরই মধ্যে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবকে ভারতের নীলনকশায় ‘বেহাত বিপ্লব’ হওয়ার আশঙ্কার কথা বলতে শুরু করেছেন নাগরিক সমাজ। আর এই আশঙ্কার কারণটি হচ্ছেন আসিফ নজরুল। তার প্রতিশ্রুতির লাইনচ্যুতি। তিনি কি বলে ছাত্র-জনতাকে আশ্বস্ত করেছিলেন, বাস্তবে কি করছেন ? কোন্ দিকে খেলছেন তিনি ?
গণহত্যা তথা ছাত্র-জনতা হত্যার বিচার শুরুর লক্ষ্যে কার্যকর তেমন কিছুই করেননি আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। একজন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি ভালো ভালো কথা বলছেন। অথচ হাসিনার মাফিয়াতন্ত্র এবং ফ্যাসিবাদের দোসর বিচারপতিদের এখনো ‘ইনট্যাক্ট’ রেখে দিয়েছেন পুর্ণমর্যাদায়। তাদের নিয়োগ বাতিল, প্রত্যাহার, আইনের আওতায় এনে বিচার করাতো দূরে থাক-তাদেরকে ব্যবহার করতে দিয়ে রাখা হয়েছে সুপ্রিমকোর্টের পতাকা ওড়ানো গাড়ি। বসবাসের জন্য দিয়ে রেখছেন আলীশান সরকারি বাসা। ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদখ্যাত’ সাবেক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, এম.ইনায়েতুর রহিমগংরা পদত্যাগ করেছেন মাত্র। তাদেরকে এখনো আইনের আওতায় আনা হয়নি। বিচারতো দূর কা বাত।
শেখ হাসিনার ধ্বংস করে যাওয়া প্রতিষ্ঠান সংস্কারের বহুবিধ কমিশন হয়েছে। বিচার বিভাগ সংস্কারেরও একখানা কমিশন গঠিত হয়েছে। যদিও এদেশে ‘কমিশন’র ইতিহাস সুখকর নয়। অনেকে মনে করেন, এসবই কালবিলম্বের ‘টুলস’। মানুষ গণহত্যার দ্রুত বিচার চায়। খুনি শেখ হাসিনার শাস্তি উপভোগ করতে চায়। কিন্তু সেই আকাঙ্খায় পানি ঢেলে দেয়া হলো কথিত ‘সংস্কার কমিশন’র কথা বলে। অনেকে মনে করেন, সংস্কার হওয়াটা জরুরি। কিন্তু সেটি হতে পারে খুনি শেখ হাসিনা এবং তার দোসরদের শাস্তি নিশ্চিত করার পর। সাংঘাতিক রকম আইনের শাসন নিশ্চিত করেছেন-মর্মে মুখে ফেনা তুলতেন হাসিনার লেসপ্যান্সার আনিসুল হক। সেই ‘আইনের শাসন’ দিয়েই গণহত্যার বিচার করাটা ছিলো শ্রেয়। এতে অন্তত কাউকে দোষারোপের সুযোগ থাকতো না। হাসিনার সংবিধান, হাসিনার আইন, হাসিনার ট্রাইব্যুনাল। নেই ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় উঠতে হয়তো শেখ হাসিনা ও তার দোসররা হয়তো স্বস্তিই বোধ করতেন। কিন্তু আসিফ নজরুলরা যেই ধাচের ‘বিচার’ শেখ হাসিনার করবেন-মর্মে মনোস্থির করেছেন-তাতে শেখ হাসিনা আরো বেশি স্বস্তি বোধ করবেন। কারণ, আসিফ নজরুলরা যখন শেখ হাসিনা ও তার বশংবদদের কাঠগড়ায় তুলবেন-তখন হয়তো দ্রোহের আগুনে তাঁতানো মানুষের ক্ষোভটাই থাকবে না। ভাঁটা পড়বে মানুষের আগ্রহে। যতই কালবিলম্ব হবে- ততোই হাসিনার স্বস্তি নিশ্চিত হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের কার্যক্রম যদি স্থবির হয়ে পড়ে, তাহলে যে হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সুযোগ বাড়বে, সে বিষয়ে সবাই একমত। ঢাকাভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের মতে, আগামী দশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হাসিনা ও তার দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কোনও সুযোগ নেই। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হলে এই প্রেক্ষাপট বদলে যেতে পারে। ব্যাপকভিত্তিক সংস্কারের ধুয়া তুলে মূল কাজ থেকে (গণহত্যার বিচার) দূরে সরকারকে দূরে রাখার মধ্যে টাইম ম্যাগাজিনের উল্লেখিত আশঙ্কার সাযুজ্য রয়েছে। বিচার শুরুতে যত বিলম্ব হবে-লাভের পাল্লা ভারি হবে গণহত্যার আসামি শেখ হাসিনার।
শেখ হাসিনা এবং তার কিছু দোসরের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা হয়েছে। দুই মাস হয়ে গেলো, তদন্ত এবং বিচার শুরুর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। প্রথমে বলা হলো, জুলাই-আগস্ট গণহত্যাকারীদের দ্রুতই বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হবে। তাদেরকে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে’ বিচার করা হবে। আইনত: ট্রাইব্যুনাল গঠন হয়ে থাকলেও কার্যত: শুরু করা যায় নি বিচার। তদন্ত সংস্থায় দু’জন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পুরনো অফিস স্টাফ ছিলো ৮ জন। প্রসিকিউশনে নিয়োগ দেয়া হয়েছে চীফ প্রসিকিউটরসহ কয়েক জন। অথচ ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগের কোনো খবর নেই। গত এক মাসে ‘শিঘ্রই ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগ দেয়া হবে’ মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে কয়েক বার। আসিফ নজরুল ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগ দূরে থাক, হাইকোর্ট বিভাগেই বিচারপতি নিয়োগ দিতে পারেননি। অথচ বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার মতো বহু দক্ষ ও সাহসী আইনজীবী এবং জুডিশিয়াল সার্ভিসের বিচারকের অভাব নেই। আসিফ নজরুলের সঙ্গে তাদের যেহেতু ‘ব্যক্তিগত জানাশোনা’ নেই, তাই তাদেরকে এসব পদে যোগ্য মনে করছেন না। বিচারপতি নিয়োগও করতে পারছেন না। আবার তুলেছেন ১৯৭৩ সালের ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট’র সংশোধন প্রশ্ন। সংশোধনে সেমিনার করে মতামত নিচ্ছেন তার ‘পছন্দসই’ লোকজনের। যদিও অনেক আইনজীবী মনে করেন, শেখ হাসিনা যে আইনে বিএনপি-জামাত নেতাদের ফাঁসি দিয়েছেন,একই আইনে গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা এবং তার পারিষদ সদস্যেরও বিচার করা সম্ভব। ্ জন্য প্রয়োজন নেই কোনো সংশোধনের। যে আইন শেখ হাসিনা ধারালো অস্ত্রের মতো ব্যবহার করে বিএনপি-জামায়াতকে নেতৃত্বশূন্য করলো সেই আইনকি তবে আসিফ নজরুলের হাতে পড়ে ভোঁতা হয়ে গেলো ? এক অদৃশ্য সূতোর টানে এভাবেই পেছাচ্ছে গণহত্যাকারীদের বিচার।
আসা যাক অধস্তন আদালতে। দেড় দশক আ’লীগ টিকেই ছিলো মামলার ওপর। জঙ্গি নাটক, জামাত-বিএনপি’র গোপন বৈঠক’, সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র, নাশকতার দায়ে করা লাখ লাখ ভুয়া মামলায় শেখ হাসিনার ফ্যাসিজমের পক্ষ নিয়ে বিচার করেছেন অধস্তন আদালতের বিচারকরা। ভুয়া মামলার রায় প্রদানকারী একজন বিচারককেও এখন পর্যন্ত আইনের আওতায় আনেননি আসিফ নজরুল। যখনই গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এবং তার দোসরদের বিচারের প্রসঙ্গ এলো, তখনই জিগির তুলেছেন বিচার বিভাগকে সরকারের প্রভাবমুক্ত রাখার। যদিও এসব প্রসঙ্গ এখন নয়। তোলা যেতো গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করার পর।
বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা মামলায় বিচারক মোতাহার ন্যায় সঙ্গত রায় দিয়েও টিকতে পারেননি। তাকে দেশ ছাড়া করা হয়েছে। পরিবারটিকেই ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হয়েছে। দুদককে দিয়ে উল্টো ভুয়া মামলা করা হয়েছে। এসব কাজ করতে শেখ হাসিনা একমুহূর্তও বিলম্ব করেননি। পক্ষান্তরে দেড় দশক ধরে শেখ হাসিনার আজ্ঞাবহনকারী ও ভুয়া মামলায মিথ্যা রায় প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আসিফ নজরুল যারপরনাই কুণ্ঠিত। মিথ্যা রায় দেয়ার অপরাধে একজন বিচারককেও তিনি চাকুরিচ্যুত করেননি। আইনের আওতায় আনাতো দূরকা বাত। অভিযোগ রয়েছে, প্রাইজ পোস্টিংয়ের।
বেছে বেছে ছাত্রলীগ করা ছেলেদের বিচারক নিয়োগ দেন শেখ হাসিনা। সেই বিচারকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো পুরষ্কৃত করছেন। ১৫ বছর ধরে নিগৃত বিচারকদের পোস্টিং দিচ্ছেন ঢাকার বাইরে। আওয়ামী আমলে সুবিধাভোগী দালাল বিচারকদের মুখ চিনে পোস্টিং দিচ্ছেন মন্ত্রণালয়, ঢাকায় কিংবা ঢাকার আশপাশে।
হাসিনার আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কালেক্টর ছিলেন তৎকালিন আইন সচিব গোলাম সারোয়ার ও যুগ্মসচিব বিকাশ কুমার সাহা। আসিফ নজরুল যোগদান করে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে অফিস করেছেন। কানাঘুষা শুরু হলে প্রথমে বিকাশ সাহাকে ওএসডি করেন। এরও দুই সপ্তাহ পর ওএসডি করেন গোলাম সারোয়ারকে। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও চাকরিচ্যুত করেন নি। তাদের গ্রেফতারও করেননি। গোলাম সারোয়ারের বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছেন আরেক শেখ হাসিনার আরেক ‘গোলাম’কে। যার বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেঙ্কারির কোনো অভিযোগ না থাকলেও রয়েছে কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় ঢাকায় অবস্থানের। ইতিপূর্বে তিনি সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল, হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার,দুদকের পরিচালক (লিগ্যাল) এবং শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে পেয়েছেন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার কৃপা-দৃষ্টি। দু’দিন পরই তার অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়ার কথা। কিন্তু আসিফ নজরুল তাকে চুক্তিভিত্তিক রেখে দেয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।
জানাগেছে, মজলুম সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানকে ফের কারাগারে পাঠানো, তিনি আত্মসমর্পণ করে শেখ হাসিনার আইন প্রতিপালনে বাধ্যবাধকতা না দেখানোয় ফের কারাগারে প্রেরণ,বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মামলা স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রত্যাহার না করা, বেগম খালেদা জিয়ার মামলা প্রত্যাহারে গরিমসির নেপথ্যে রয়েছে রয়েছে এই আইনসচিব গোলাম রাব্বানীর মন্ত্রণা। যা শেখ হাসিনার এজেন্ডারই অংশ।
শেখ হাসিনার শাস্তি নিশ্চিত করা না হলে তিনি আগামি জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন। এ কারণে শেখ হাসিনার বিচারে কালক্ষেপণের কৌশল নিয়েছেন আসিফ নজরুল। ভারতের পরিকল্পনায় হাটছেন তিনি। একই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে বিলম্ব ঘটাচ্ছেন তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন প্রশ্নেও। গত দেড় যুগে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকার এবং শেখ হাসিনার সময়ে সবচেয়ে বেশি নিগৃহিত হয়েছে জিয়া পরিবার। অথচ এ পরিবারের কারোর মামলা প্রত্যাহার কিংবা সাজা বাতিলের ঘোষণা আসিফ নজরুলের মুখ থেকে আগে আসেনি। তারেক রহমানের মামলাকেও ফেলে রেখেছেন হাসিনার ‘আইনগত প্রক্রিয়া’র ভেতর। যদিও আসিফ নজরুলের উপদেষ্টা পদে আসীন হওয়াটাও কোনো আইন মেনে হয়নি। কূটকৌশল করে তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে বিলম্বিত করা এবং শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার ভারতের অভিন্ন এজেন্ডার দু’টি দিক। ‘প্রভূপ্রদত্ত’ এই এজেন্ডা সফল করতেই আসিফ নজরুলরা এ সরকারে ঢুকেছেন। এসব কথা এখন মাঠে-ময়দানে উন্মুক্ত আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
Add Comment