প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব ও মর্যাদার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকার ঘোষণা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেছেন, আজ বুধবারের বৈঠকে উপস্থিত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা ছিল। তবে সবাই দেশের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা বলেছেন।
জাতীয় ঐক্যের আহ্বান নিয়ে আজ বিকেলে বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন ড. ইউনূস। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আসিফ নজরুল।
বৈঠকে ভারতে বাংলাদেশবিরোধী বিভিন্ন তৎপরতা, আগরতলায় সহকারী হাইকমিশনে হামলা, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপ ইত্যাদির তীব্র নিন্দা জানানো হয় বলে উল্লেখ করেন আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, বৈঠকে এসবের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের পদক্ষেপ ও সাহসী ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে এবং সরকারের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি বলেন, বৈঠকে ভারতের বিরুদ্ধে আরও শক্তিশালীভাবে সরকারকে বিষয়গুলো ‘অ্যাড্রেস’ করার কথা বলা হয়েছে। এ জন্য প্রবাসী বন্ধু ও অন্য বন্ধুরাষ্ট্রের সহযোগিতা নেওয়া এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলোকে ডেকে নিয়ে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সরকারের যোগাযোগ দক্ষতা ও আইনি দক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শও এসেছে।
আসিফ নজরুল বলেন, বৈঠকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের হওয়া চুক্তিগুলো প্রকাশ করা এবং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ দেশের জন্য ক্ষতিকর চুক্তি বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের যে অর্থনৈতিক নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের যে চেষ্টা, অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপের যে চেষ্টা, সেটির নিন্দা জানান বৈঠকে উপস্থিত রাজনীতিবিদেরা। পাশাপাশি তাঁরা ভারতকে মর্যাদাশীল এবং সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
আসিফ নজরুল জানান, ভারত বাংলাদেশবিরোধী যে বিভিন্ন প্রচারণা চালাচ্ছে, সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব সম্প্রদায়ের মানুষের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে বৈঠকে। পাশাপাশি যেকোনো উসকানির মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সবাই বলেছেন, আমাদের আর শক্তিহীন, দুর্বল ও নতজানু ভাবার কোনো অবকাশ নেই। যেকোনো ধরনের অপপ্রচার ও উসকানির বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব, সাহসী থাকব।’
বৈঠকে সবাই মিলে একটি সমাবেশ করা, সবাই মিলে একটি ‘পলিটিক্যাল’ কাউন্সিল করা, নিরাপত্তা কাউন্সিল করাসহ বিভিন্ন প্রস্তাব এসেছে বলে জানান আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘সভার মূল সুর ছিল, আমাদের মধ্যে মত, পথ ও আদর্শের ভিন্নতা থাকতে পারে, অবস্থানে ভিন্নতা থাকতে পারে; কিন্তু দেশ, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সবাই এক। সবার ওপরে দেশ। রাজনৈতিক সমাবেশের মাধ্যমে এই বার্তা জানিয়ে দিতে বলা হয়েছে।’
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। বিএনপির প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন।
জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ চার সদস্যের প্রতিনিধিদল এবং বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনুস আহমাদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বৈঠকে অংশ নিয়েছেন।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী ও সদস্যসচিব আখতার হোসেন আজকের বৈঠকে ছিলেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মো. শাহ আলম ও সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, জাতীয় পার্টির (জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু ও যুগ্ম আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বৈঠকে অংশ নেন।
বৈঠকে আরও অংশ নেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির শহীদউদ্দিন মাহমুদ, বাংলাদেশ জাসদের শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও নাজমুল হক প্রধান, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের ফয়জুল হক লালা, জাতীয় জোটের এহসানুল হুদা, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, বিকল্প ধারা বাংলাদেশের (একাংশ) নুরুল আমিন ব্যাপারী, ভাসানী অনুসারী পরিষদের রফিকুল ইসলাম বাবলু, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মামুনুল হক, খেলাফত মজলিসের আবদুল বাসিত আজাদ ও জাহাঙ্গীর হোসেন, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের আবদুর রব ইউসুফী ও মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মুফতি ফখরুল ইসলাম, গণ অধিকার পরিষদের (ফারুক) সদস্যসচিব ফারুক হাসান, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএমের ববি হাজ্জাজ, জাগপার (একাংশ) রাশেদ প্রধান, এনডিপির আবু তাহের প্রমুখ।
আরও কিছু রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে ছাত্রনেতা, রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছেন প্রধান উপদেষ্টা। গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগের কথা জানায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। গতকাল সন্ধ্যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বৈঠক হয়। আজ হয়েছে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক। আগামীকাল প্রধান উপদেষ্টা বসবেন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে।
দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন সবাই মিলে আমরা একজোট হয়ে যেন কাজটা করতে পারি। সবাই একত্র হয়ে বললে একটা সমবেত শক্তি তৈরি হয়, এই সমবেত শক্তির জন্যই আপনাদের সঙ্গে বসা।
বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে এ কথা বলেন তিনি। বিকাল ৪টায় শুরু হওয়া বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
ড. ইউনূস বলেন, আমরা কেন জানি মানুষের ক্রোধ থেকে মুক্ত হতে পারছি না। বিজয়ের মাসে আরো বেশি করে আনন্দ করার কথা আমাদের। কিন্তু আমাদের এই স্বাধীনতা অনেকের কাছে পছন্দ হচ্ছে না। ৫ই আগস্টের পর থেকে কী হয়েছে, বাস্তবের পরিপ্রেক্ষিতে আপনারা তা দেখেছেন। আমরা এই পরিস্থিতিতে মনে করেছিলাম দুর্গাপূজা নিয়ে একটা হাঙ্গামা শুরু হবে। সেখানে আপনারা সবাই ঐক্যের মধ্যে শরিক হয়েছিলেন। সারাদেশ জুড়ে শান্তিপূর্ণভাবে পূজা পালিত হয়েছে। কোথাও কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা হয়নি। সেটাও অনেকের পছন্দ হয়নি। দেশকে নতুন করে অস্থির করার চেষ্টা চলছে। এখন যে চেষ্টা চলছে সেখানে বিশেষভাবে আমরা আপনাদের চাচ্ছি।
তিনি বলেন, যে বাংলাদেশ আমরা গড়ে তোলার চেষ্টা করছি, সেটাকে ধামাচাপা দিয়ে তারা আগের বাংলাদেশের কাহিনী রচনা করে যাচ্ছে। সারাক্ষণ নানা রূপে তারা এটা করে যাচ্ছে। এটা যে শুধু এক দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে তাও নয়, বড় দেশের মধ্যেও এটি ছড়িয়ে গেছে। আমাদের এই অভ্যুত্থানটা তাদের পছন্দ হয়নি। তারা এটাকে নতুন ভঙ্গিতে দুনিয়ার সামনে পেশ করতে চায়। এই ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে আমাদের দেশকে রক্ষা করতে হবে। এখন সেগুলোকে মিথ্যা প্রমাণ করা বা বাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমাদের সবাইকে একজোট হতে হবে। এটা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের বিষয় না। জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বের বিষয়।
বাংলাদেশ নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি করলাম, তারা এটাকে মুছে দিয়ে আগেরটায় ফিরে যেতে চায়। মুখে বলছে না যে আগেরটা, কিন্তু ভঙ্গি হলো আগেরটা ভালো ছিল। তাদের শক্তি এত বেশি যে তারা মানুষকে এর ভেতরে ভেড়াতে পারছে। তাদের কল্পকাহিনীর কারণে মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করছে যে এটা কী ধরনের সরকার হলো।
বর্হিবিশ্বের মিডিয়া নিয়ে ড. ইউনূস বলেন, আমরা বার-বার তাদের বলছি যে, আপনারা আসেন এখানে, দেখেন, এখানে কোনো বাঁধা নেই। কিন্তু না, তারা ওখান থেকেই কল্পকাহিনী বানিয়ে যাচ্ছে। এখন আমাদের সারা দুনিয়াকে বলতে হবে যে, আমরা এক, আমরা যেটা পেয়েছি সেটা একজোট হয়ে পেয়েছি, কোনো মতবাদের কারণে পাইনি, ধাক্কাধাক্কি করে পাইনি, যারা আমাদের ওপর চেপে ছিল, তাদের উপড়ে ফেলেছি। এটাই সবার সামনে তুলে ধরতে হবে, সবাই মিলে যেন এটা করতে পারি। আমাদের নতুন বাংলাদেশের যাত্রাপথে এটা মস্ত বড় একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, অস্তিত্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
Add Comment