মানবাধিকার

ইসরাইল নয়, প্যালেস্টাইনের ভিসা নিয়ে দেখতে চাই বাইতুল মোকাদ্দস

গাজী মিজানুর রহমান , সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট এবং  লেখক

কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের পাসপোর্টে   ‘ইসরাইল ব্যতীত ‘  কথাটা  উঠিয়ে দেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে  সমালোচনার ঢেউ উঠেছিল।  পাসপোর্ট নিয়ে এই  যে উত্তাপ , তার কারণ  ইসরাইল রাষ্ট্রটির  সীমাহীন একগুঁয়েমি এবং ফিলিস্তিনিদের উপর দীর্ঘকাল ধরে তার নিবর্তনমূলক শাসনব্যবস্থা আরোপ । ফিলিস্তিনিদের সাথে আলোচনা না করে একতরফাভাবে ১৯৪৮ সালে প্যালেস্টাইনের ভেতরে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন করার পর ওই এলাকায় উত্তেজনা শুরু হয় ।

১৯৬৭ সালে ইসরাইল  সিরিয়ার গোলান হাইটস-সহ  গাজা এলাকা , পূর্ব জেরুজালেম ও  পশ্চিম তীর দখল করে নেয়।  ইসরাইলের ভিতরে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিরা এবং প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশানাল অথরিটি-শাসিত এলাকার ফিলিস্তিনিরা সেই থেকে নিজ দেশে পরবাসী । তবে আশার কথা হচ্ছে ,  ইসরাইলে যা-কিছু  দেখার , বিশেষ করে ধর্মীয় স্থাপনা-তার বেশিরভাগ  প্যালেস্টিনিয়ান  ন্যাশানাল  অথরিটি এর আওতাধীন এলাকায়  অবস্থিত । তাই  প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠিত হলে সে দেশের  ভিসা নিয়েই এগুলো দর্শন করতে পারবে বাংলাদেশের মানুষ  । ধর্মীয় স্থাপনাবিশিষ্ট   পুরাতন জেরুজালেম , বেথলিহেম  এবং  হেবরন   পি.এন.এ শাসিত  এলাকায় অবস্থিত ।  দাউদ (আ) এবং ইসা (আ) এর জন্মস্থান বেথলিহেম পুরাতন জেরুজালেম  থেকে  ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আবার  হেবরন  জেরুজালেম থেকে ২৮  কিলোমিটার দূরে অবস্থিত । রাজা ডেভিড বা দাউদ (আ) তার রাজ্যের রাজধানী জেরুজালেমে স্থানান্তরিত করার আগে জুডাহ এবং ইসরায়েল রাজ্যের রাজধানী ছিল হেবরনে ।

হযরত ইব্রাহিম (আ) ইরাকের উর এলাকা থেকে এসে হেবরনে বসবাস করতেন । এখানে হযরত ইব্রাহিম (আ) , ইসাহাক (আ) , ইয়াকুব (আ) এবং তাদের  স্ত্রীগণের কবর রয়েছে ।

পুরাতন জেরুজালেমে অবস্থিত হারাম আল শরিফ  বা আল-আকসা কম্পাউন্ড   পাহাড়ের উপরে অবস্থিত একটি  এলাকা । ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষেরা এটাকে টেম্পল মাউন্ট বলে ।  এখানে রয়েছে কুব্বাত আস সাখরা (ডোম অব দ্য রক )  ,  আল-আকসা মসজিদ  , এবং আরও দু-একটি ধর্মীয়  স্থাপনা ।  আল-আকসা কম্পাউন্ডের  স্থানে ইব্রাহিম (আ) কাবা ঘরের মতো  একটি ইবাদত গৃহ  নির্মাণ  করেছিলেন ।

ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের কাছে এটা অতি পবিত্র এই কারণে যে , এখান থেকেই আমাদের প্রিয়  নবি হযরত মুহাম্মদ (সা:) সাত আসমান ভ্রমণের জন্য আকাশে গমন করেন ।  আমরা আল-আকসা কম্পাউন্ডের  নানা ভিডিও  এবং ছবিতে যে সোনালী গম্বুজ-বিশিষ্ট একটা আট-কোণবিশিষ্ট  ভবন দেখি ,  সেটাই কুব্বাত আস সাখরা বা  ডোম অব দ্য রক ।

এর অভ্যন্তরে  মেঝেতে রক্ষিত আছে সেই  পাথর  যেখান থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা:) মিরাজের জন্য ঊর্ধ্বাকাশে গমন করেন । ইসলামের শুরুতে  বেশ কয়েক  বছর মুসলমানেরা  এই স্থাপনার দিকে  মুখ করে নামাজ পড়তো । এছাড়া মুসলমানেরা ইব্রাহিম (আ) , ইসাহাক (আ) , দাউদ (আ) ,  সুলাইমান (আ) কে নবি হিসেবে মানে ।  তাই তাদের স্মৃতিধন্য  স্থান  ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের কাছেও  পবিত্র ।

অন্যদিকে  ইহুদি ধর্মের মানুষেরা বিশ্বাস করে যে , এখানেই তাদের  প্রথম টেম্পল এবং দ্বিতীয় টেম্পল ছিল । ইহুদি ধর্মানুসারীদের দাবিমতে,  সুলেমান (আ) ৯৫৭  খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে তার ইবাদত ঘর নির্মাণ করেছিলেন , যা  প্রথম টেম্পল হিসেবে পরিচিত ।  খ্রিষ্টপূর্ব  ৫৮৬   অব্দে ব্যবিলনীয় রাজা নেবুচাদনেজার এই টেম্পল  ধ্বংস করেন । ইহুদি ঐতিহাসিকদের মতে, ব্যবিলন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ইহুদি ধর্মীয় নেতা জেরুবাবেল ,  হাগাই এবং জেকারিয়ার  তত্ত্ববধানে  ৫১৫ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে  দ্বিতীয় টেম্পল পুনর্নিমিত হয়  । দ্বিতীয় টেম্পল নির্মাণে  নবি উজায়ের (আ) এরও অবদান ছিল  । অতঃপর  জুডিয়া এলাকার রোমান  রাজা হেরড  খ্রিষ্টপূর্ব ২০  অব্দে দ্বিতীয় টেম্পলকে বর্ধিত আকারে পুনর্নিমাণ করেন  । পুনর্নিমাণের  ৯০  বছর পর ৭০ খ্রিস্টাব্দে  ইহুদি জনগোষ্ঠির  বিদ্রোহের কারণে  রোমান সম্রাট  টাইটাস দ্বিতীয় টেম্পল মাটিতে মিশিয়ে দেন  এবং স্থানটিকে তাদের  দেব-দেবীদের  পূঁজার স্থান হিসেবে ব্যবহার করা শুরু  করেন  ।

রোমানদের হাত ঘুরে যখন শাসন-ক্ষমতা  আসে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের কাছে তখন টেম্পল মাউন্ট পরিত্যাক্ত অবস্থায় ছিল ।  কারণ  খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের জন্য এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হচ্ছে চার্চ অব দ্য হলি সেপুলকার , যা  এই টেম্পল মাউন্টের কিছু দূরে পুরাতন জেরুজালেম শহরের খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থিত ।  আল আকসা কম্পাউন্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমে মূল কম্পাউন্ডের বাইরে দ্বিতীয় টেম্পলের  ধ্বংসপ্রাপ্ত দেয়ালের কিছু অংশ পশ্চিম দেয়াল নামে পরিচিত । এখানে   ইহুদি ধর্মের অনুসারীগণ এসে প্রার্থনা করেন ।  এখান থেকে একটা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে আল-আকসা কম্পাউন্ডের ভিতরে যাওয়া যায় ।

টেম্পল মাউন্ট  কম্পাউন্ডের  উত্তর দিকের প্রায় মাঝখানটায়  ছিল পবিত্র পাথর সাখরার  চত্বর । ৬৩৭ সালে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা)  প্রাঙ্গনটির   সর্বদক্ষিণ দিকে খোলা জায়গায়  একটি   মসজিদ নির্মাণ  করেন   ।  এটাই  আল-আকসা মসজিদ । এটা প্রথমে ছোট একটা স্থাপনা ছিল । উমাইয়া  খলিফা আব্দুল মালিকের সময় তা  বৃহৎ কলেবরে  নির্মিত হয় ।  তিনি আল আকসা  মসজিদের উত্তরে খোলা  চত্বরে  পবিত্র পাথরের    উপর ৬৯১-৯২ খ্রিস্টাব্দে  আচ্ছাদন বা ডোম নির্মাণ করেন । সেই থেকে এর নাম হয় ডোম অব দ্য রক বা কুব্বাত আস সাখরা ।   ১০৯৯ সালে ক্রুসেডারদের দখলে যাওয়ার পর আল-আকসা মসজিদকে তারা রাজপ্রাসাদ হিসেবে এবং ডোম অব দ্যা রককে গির্জা হিসেবে ব্যবহার করতো । পরে এটা  নাইটদের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়  । টেম্পল মাউন্ট বা আল-আকসা কম্পাউন্ডের বাকি এলাকায় খ্রিস্টান শাসকেরা পরিত্যক্ত মালামাল স্তুপ করে রেখেছিল ।

১১৮৭ সালে রাজা  সালাউদ্দিন আইয়ুবি জেরুজালেম  পুনর্দখল করার পর আবার সব ইসলামিক কায়দা-কানুন ফিরিয়ে আনা হয় ও সংস্কার কাজ করা হয় । তিনিই প্রথম গম্বুজের নিচে চারিদিকে দেয়াল স্থাপন করেন । প্রথমদিকে এটা মোজাইক করা  ছিল । অটোম্যান সুলতান সুলাইমান টাইলস দিয়ে কুব্বাত আস সাখরার বাইরের দেয়ালের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন । ভেতরের দেয়ালও সংস্কার করেন তিনি ।  ডোম অব দ্য রকের দেয়ালে কুরআনের আয়াত লিপিবদ্ধ করা হয়  । ১৯৬৪ সালে জর্ডান সরকার কর্তৃক প্রদত্ত  এলুমিনিয়াম ও ব্রঞ্জের মিশ্রণে নির্মিত ধাতু দিয়ে গম্বুজের উপরিভাগ  ঢেকে দেয়া হয় ।  ১৯৯৩ সালে জর্ডানের বাদশা হুসেইন-প্রদত্ত  ৮০ কেজি স্বর্ণ দিয়ে গম্বুজের সৌন্দর্য বর্ধন করা হয় । কুব্বাত আস সাখরা  কখনো মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত  হয়নি । এটা একটা ‘শ্রাইন’  বা পবিত্র স্থান । অন্যদিকে আল-আকসা মসজিদ দুইবার ভূমিকম্পের দ্বারা বিধ্বস্ত হয় এবং সংস্কার কাজ করা হয় । প্রতিবারই এর মুসল্লি ধারণক্ষমতা বাড়ানো হয় । এই কম্পাউন্ড ফিলিস্তিনী মুসলমানদের দ্বারা গঠিত একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে । শুক্রবার এবং শনিবার দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে। সপ্তাহের অন্য দিনে মার্জিত পোষাকে ইহুদী এবং খ্রিস্টান ধর্মের লোকেরা তাদের কোনো ধর্মগ্রন্থ সাথে না নিয়ে কমপ্লেক্স দর্শন করতে পারেন । তবে তাদের জন্য ডোম অব দ্য রকের ভেতরে প্রবেশ নিষিদ্ধ আছে । এই ব্যবস্থা সকল পক্ষের সম্মতিতে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে ।

স্থায়ী শান্তির স্বার্থে  অসলো চুক্তির (Oslo accords)  ধারাবাহিকতায়  বর্তমান গাজা  আর পশ্চিম তীর নিয়ে যে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠনের  স্বপ্ন দেখছে শান্তিপ্রিয় মানুষ, তা  পূর্ণাঙ্গভাবে  বাস্তবায়িত হলে এবং  প্যালেস্টাইনে   শান্তিপূর্ণ অবস্থা ফিরে আসলে  অনেকের পক্ষে  পবিত্র কুরআনে বর্ণিত  বহু  নবির জন্মস্থান ও ঐতিহাসিক স্থাপনাসমূহ দেখার সৌভাগ্য হতো ।

বাংলাদেশের মানুষও পুরাতন জেরুজালেমের  আল-আকসা কম্পাউন্ড , হেবরন , বেথলিহেম , জেরিকো সহ অন্যান্য  স্থান দর্শন করতে আগ্রহী। কিন্তু  ইসরাইলের ভিসা নিয়ে কেউ  সে দেশ  ভ্রমণে  আগ্রহী  নয় । বিশ্ব-সম্প্রদায়ের অঙ্গীকার মোতাবেক স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠিত হোক ,  প্যালেস্টাইন এবং ইসরাইল একে-অপরকে স্বীকৃতি দিক , এটাই বিশ্ববাসীর আকাঙ্ক্ষা ।  এমন হলে  প্যালেস্টাইনের ভিসা নিয়ে  বাংলাদেশিরা দেখে  আসতে পারবে  তাদের প্রিয় বাইতুল মোকাদ্দস  এবং এর আশেপাশের প্রাচীন স্থাপনাগুলো । সে পর্যন্ত ইসরাইল ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা যা আছে , তা বলবৎ থাকুক, এটাই মানুষের প্রত্যাশা।

(গাজী মিজানুর রহমান , সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট এবং  লেখক)

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১৩
১৫১৬১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭
৩০