মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বর্তমানে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। রায়ের পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাঁকে ফেরত দিতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু ভারত কি তাঁকে ফেরত দেবে? এ নিয়ে আল–জাজিরার অনলাইন সংস্করণে আজ মঙ্গলবার বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন করেছেন যশরাজ শর্মা।

২৪ বছর বয়সী সীমা আখতার ফুটবল খেলার অনুশীলন করছিলেন। হঠাৎই এক বন্ধু এসে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে একটি খবর জানালেন। বললেন, বাংলাদেশের পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীর কাছে রায়টিকে ন্যায়বিচারের এক মুহূর্ত বলে মনে হচ্ছিল।
গত বছর বিক্ষোভকারীদের ওপর শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বাহিনী দমন–পীড়ন চালায়। সে সময় সীমা আখতারের কয়েকজন বন্ধুও নিহত হন।
শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেন এবং বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান।
ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৭৮ বছর বয়সী এ নেত্রীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে বিচারকাজ চলেছে। কয়েক মাস ধরে বিচারপ্রক্রিয়া চলার পর আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। গত বছর বিক্ষোভ দমনে প্রাণঘাতী অভিযান চালানোর জন্য নির্দেশ দেওয়ার দায়ে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
ঢাকা থেকে সীমা আখতার বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী হাসিনা ভেবেছিলেন, তাঁকে কখনো পরাজিত করা যাবে না। তিনি চিরদিন শাসনক্ষমতায় থাকতে পারবেন। তাঁর মৃত্যুদণ্ড আমাদের শহীদদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে একটি পদক্ষেপ।’
সীমা মনে করেন, শুধু সাজা ঘোষণাই যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখতে চাই, তাঁকে এই ঢাকাতেই ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে।’
কিন্তু কাজটা এত সহজ নয়।
২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা ঢাকা ছেড়ে চলে যান। বর্তমানে তিনি ভারতের আশ্রয়ে আছেন।
শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার জন্য বারবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ সত্ত্বেও তাঁকে ফেরত দেওয়া হয়নি। বিষয়টি ১৫ মাস ধরে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তেজনার অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে। এখন হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘটনায় এই উত্তেজনা নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
যদিও ভারত হাসিনা–পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। কয়েকজন ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন, তাঁরা এমন কোনো দৃশ্য কল্পনাও করতে পারছেন না যে নয়াদিল্লি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি করতে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে।
ঢাকায় ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী প্রশ্ন করেন, ‘নয়াদিল্লি কীভাবে তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে?’
ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক দক্ষিণ এশীয় বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ভারতে হাসিনার উপস্থিতিটা ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে কাঁটা হয়ে থাকবে’। তবে এর মধ্য দিয়ে ভারত তার মিত্রদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার প্রতিশ্রুতি পালন করতে সক্ষম হয়েছে।
‘অত্যন্ত অবন্ধুসুলভ পদক্ষেপ’
হাসিনা বাংলাদেশের দীর্ঘতম সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে তিনি।
শেখ হাসিনা প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন ১৯৯৬ সালে। ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর তিনি কয়েক বছর ক্ষমতার বাইরে ছিলেন। ২০০৯ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি আবার ক্ষমতায় ফেরেন। এরপর টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি যে নির্বাচনগুলোতে জয়ী হয়েছেন, সেগুলো প্রায়ই বিরোধী দল বর্জন করেছে কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পায়নি।
এ সময় হাজার হাজার মানুষকে জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে। অনেককে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ওই সময় নির্যাতনের ঘটনা সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছিল এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অনেককে কোনো বিচার ছাড়াই কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
হাসিনা সরকার তাদের অর্থনৈতিক সাফল্যকে সামনে এনে তাঁর শাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার একসময় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের মোট দেশীয় উৎপাদন (জিডিপি) দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে ভারতের তুলনায় এগিয়ে গেছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি–নাতনিদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটার বিধানে সংস্কার চেয়ে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। বিক্ষোভকারীদের ওপর নিরাপত্তাবাহিনীর নৃশংস দমন অভিযানের পর ওই বিক্ষোভ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে রূপ নেয়। তখন দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকায় বিক্ষোভকারীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের মিত্রতা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তিনি নয়াদিল্লিতে পালিয়ে যান। নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। এরপর মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা চলার মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভারতের সঙ্গে উত্তদেজনা দেখা দেয়।
গত মঙ্গলবার ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর আরও জোরালো করেছে। মন্ত্রণালয় ভারতের সঙ্গে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তির কথা উল্লেখ করেছে। তারা বলেছে, প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো নয়াদিল্লির জন্য ‘আবশ্যিক দায়িত্ব’। তারা আরও বলেছে, ভারত যদি হাসিনাকে ক্রমাগত আশ্রয় দিয়ে যায়, তাহলে তা হবে ‘অত্যন্ত অবন্ধুসুলভ পদক্ষেপ এবং ন্যায়বিচারের প্রতি অসম্মান’।
তবে ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা আল–জাজিরাকে বলেছেন, প্রত্যর্পণ চুক্তিতে একটি ব্যতিক্রমের কথা বলা আছে। ‘রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের’ ক্ষেত্রে এ ব্যতিক্রমী ধারা ব্যবহার করা যাবে।
নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ বলেন, ‘ভারত এই ঘটনাকে (হাসিনার মামলা) বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তিগুলোর রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবে দেখছে।’
ভরদ্বাজ আল–জাজিরাকে আরও বলেন, নয়াদিল্লি মনে করে, বর্তমানে বাংলাদেশে ‘ভারতবিরোধী শক্তি’ ক্ষমতায় আছে। ইউনূস প্রায়ই ভারতের সমালোচনা করেন। হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করা বিক্ষোভ আন্দোলনের নেতা ও অংশগ্রহণকারীরাও প্রায়ই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন দেওয়ার জন্য নয়াদিল্লিকে দায়ী করেন।










Add Comment